Advertisement
E-Paper

বয়স বাধা নয়, দৌড়ে প্রমাণ করছেন ওঁরা

কেউ আগামী জানুয়ারিতে আশিতে পড়বেন। কেউ এখন ৬৩। কেউ বা ৭৩। বাড়ির আটপৌরে কাজ সামলানো তো আছেই। কিন্তু ভোর হলেই ওঁদের টানে সবুজ মাঠ। শুরু হয়ে যায় দৌড়। ৩৬৫ দিন একই নিয়ম।

সীমান্ত মৈত্র

শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০১:০৩
অনুশীলনে ব্যস্ত খেলোয়াড়রা। —নিজস্ব চিত্র।

অনুশীলনে ব্যস্ত খেলোয়াড়রা। —নিজস্ব চিত্র।

কেউ আগামী জানুয়ারিতে আশিতে পড়বেন।

কেউ এখন ৬৩। কেউ বা ৭৩।

বাড়ির আটপৌরে কাজ সামলানো তো আছেই। কিন্তু ভোর হলেই ওঁদের টানে সবুজ মাঠ। শুরু হয়ে যায় দৌড়। ৩৬৫ দিন একই নিয়ম।

বয়স এখনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি বনগাঁর গাঁড়াপোতার তারাপদ সমাজদার, কুমুদিনী বিশ্বাস, সাবিত্রী দাস বা মণীন্দ্র মল্লিকদের মতো বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের কাছে। দৌড় তাঁদের পদক এনে দিয়েছে। আর তাঁদের সাফল্য শরীরচর্চায় প্রেরণা জোগাচ্ছে যুবক-যুবতীদের। ওই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের নিয়ে গর্বের শেষ নেই এলাকার বাসিন্দাদের।

৮০ ছুঁই ছুঁই তারাপদবাবুর কথাই ধরা যাক। তুলসী পাতা চিবোতে চিবোতে প্রতিদিন ভোর ট্র্যাকসুট পরে হাজির হয়ে যান গাঁড়াপোতা উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে। বয়স্ক-ক্রীড়ায় তাঁর শুরুটা হয়েছিল এলাকায় বছর পঁচিশ আগে। স্থানীয় প্রবীণ আইনজীবী কার্তিকচন্দ্র দালালের উৎসাহে। সে বার তিনি হাঁটা প্রতিযোগিতায় নাম দেন। প্রথম বারেই সাফল্য। পরবর্তী সময়ে মহকুমা, জেলা এবং রাজ্য প্রতিযোগিতা হয়ে শেষে নেমে পড়েন জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতায়। বছর ষোলো আগে জব্বলপুরে অনুষ্ঠিত জাতীয় বয়স্ক-ক্রীড়ায় দু’শো মিটার দৌড়ে সোনা জিতেছিলেন। এ জন্য রাজ্যের তৎকালীন ক্রীড়ামন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী তাঁকে দশ হাজার টাকা উপহার দিয়েছিলেন। ২০০৭ সালে রাজ্য প্রতিযোগিতার আসর থেকে তিনি তিনটি সোনা, ২০১৩ সালে চণ্ডীগড়ে আয়োজিত জাতীয় বয়স্ক-ক্রীড়ার আসর থেকেও দু’টি সোনা জেতেন। এর মাঝেও রাজ্য এবং ভিন্ রাজ্যের সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে আয়োজিত আরও অনেক প্রতিযোগিতায় সোনার পদক তাঁর গলায় উঠেছে।

তবু, এখনও অনুশীলনে কোনও ঘাটতি নেই সামান্য জমিতে চাষ এবং দিনমজুরি করা তারাপদবাবুর। মূলত লং জাম্প এবং একশো মিটার ও দুশো মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায় নামেন তিনি। প্রতি বছর তাঁর উদ্যোগে এলাকায় বয়স্ক-ক্রীড়ার আয়োজনও হচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘আমাকে দেখে এলাকার কয়েকজনও মাঠে নেমে পড়েছেন। এটাও কম পাওনা নয়। নিজেদের সুস্থ রাখতে হলে সকালে মাঠে আসার কোনও বিকল্প নেই। সে কথা এলাকার বয়স্কদের বোঝানোর চেষ্টাও করি। বাইরে খেলা থাকলে বা ভোরে উঠে মাঠে যাওয়ার আগে স্ত্রী আমাকে প্রস্তুত করে দেন। নাতি-নাতনিদের হাতে মেডেল তুলে দিতে খুবই ভাল লাগে।’’ সাদা চুলের বছর আশির কুমুদিনী বিশ্বাসকে দেখলেই বা কে বলবে তাঁর ঘরে ভরা রয়েছে জাতীয় পুরস্কারের মেডেল!

চোখে পুরু লেন্সের চশমা। গলায় কন্ঠি। স্থানীয় কুন্দিপুরের বাসিন্দা কুমুদিনীদেবী বছর বারো আগে জয়পুরে আয়োজিত ২৮তম জাতীয় বয়স্ক-ক্রীড়ায় ৪০০ মিটার দৌড়ে প্রথম হন। এখনও নিয়ম করে রাজ্য বা জাতীয় স্তরের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় যোগ দেন। সাফল্যও আসছে। তাঁকেও বেশির ভাগ দিনই অনুশীলনে দেখা যায় গাঁড়াপোতা উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে। ভোর তিনটের সময় ঘুম থেকে উঠে মন্দিরে গিয়ে ঠাকুর প্রণাম করেন। তারপর সুযোগ পেলেই মাঠে। প্র্যাকটিসের পর ছোলা ও সয়াবিন ভেজানো খান। কিছুদিন আগেও তিনি একা থাকতেন। এখন অবশ্য বড় ছেলের কাছে থাকেন। কুমুদিনীদেবী বলেন, ‘‘কয়েক বছর আগে স্থানীয় দৌড়বিদ অর্চনা হালদারের কথায় দৌড়তে শুরু করি। দৌড়ে যা আনন্দ পাই, তা আর কিছুতে পাই না।’’

গাঁড়াপোতা পঞ্চায়েতের প্রাক্তন প্রধান ৬৩ বছরের সাবিত্রী দাসও নিয়মিত ভোরে ওই মাঠে দৌড়ন। ছ’কিলোমিটার হাঁটাও চাই। ১৯৯৮-২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি প্রধান ছিলেন। কিন্তু শুধুই রাজনীতির আঙিনায় আটকে থাকেননি। নেমে পড়েছেন মাঠে। মূলত আটশো মিটার দৌড়ে তিনি সাফল্য পেয়েছেন। বলছিলেন, ‘‘ভোরে ঘুম থেকে উঠে হাঁটা ও দৌড়ানোটা নেশার মতো হয়ে গিয়েছে।’’ কুমদিনী এবং সাবিত্রীদেবীর ‘গাইড’ এখন তারাপদবাবু। তাঁদের কথায়, ‘‘তারাপদবাবুই কোথায় কবে প্রতিযোগিতার আসর বসছে তার খোঁজখবর এনে দেন। ওঁর সঙ্গেই যাই।’’

বছর সত্তরের মণীন্দ্র মল্লিক বা সাতান্ন বছরের মধুসূদন প্রামাণিকেরাও দীর্ঘদিন নিয়মিত মাঠে এসে দৌড়ঝাঁপ করছেন। বয়সকে বাধা হতে দেননি। তাঁদের দেখাদেখি এলাকার যুবকেরাও প্র্যাকটিস করছেন।

‘তারাপদ দাদু’র প্রতি তাঁদের সকলেই রয়েছে শ্রদ্ধা। তারাপদবাবুর প্রাণায়াম, যোগ-ব্যায়াম এবং ফুটবল নিয়ে নানা কসরতের তাঁরা ভক্ত। তারাপদবাবুকে প্রায়ই শুনতে হয়, ‘‘দাদু ওই ব্যায়ামটা একটু দেখান না।’’ মাঠে আসা বরুণ অধিকারী এবং শুভঙ্কর সরকার নামে দুই যুবকের কথায়, ‘‘ছোটবেলা থেকেই দেখছি দাদু মাঠে দৌড়চ্ছেন। এই বয়সেও দাদু-ঠাকুমার (কুমুদিনীদেবী) দৌড় আমাদেরও উৎসাহিত করে। ওঁদের থেকে অনুপ্রেরণাও পাই।’’ বৃদ্ধবৃদ্ধাদের এই সাফল্যে এলাকাবাসী হিসেবে তাঁরা যে গর্বিত, তা মেনে নিয়েছেন গাঁড়াপোতা পঞ্চায়েতের প্রধান মধুসূদন বিশ্বাস।

Running competition old age man
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy