কেটে নেওয়া হয়েছে চন্দন গাছ। শান্তিনিকেতনে। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।
চন্দন গাছ চুরি অব্যাহত শান্তিনিকেতনে। বিশ্বভারতীর ক্যাম্পাসের পাশাপাশি, এলাকার বসতবাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে থাকা চন্দন গাছে এই বার নজর দিল চোরেরা।
বুধবার সকালে শান্তিনিকেতনের রতনপল্লি এলাকায় এক ব্যাক্তির বাড়ি থেকে একটি চন্দনগাছ চুরির বিষয় জানাজানি হয়। বাড়ি মালিক বিষয়টি লিখিত ভাবে, শান্তিনিকেতন তদন্ত কেন্দ্রে জানিয়েছেন। ঘটনার তদন্তে নেমেছে পুলিশ। তবে, বারে বারে এই এলাকা তো বটেই, বীরভূম এবং লাগোয়া মুর্শিদাবাদ ও মেদিনীপুর প্রভৃতি জেলা থেকে ইদানিং পর পর চন্দন গাছ চুরি হওয়ায় রাজ্যজুড়ে চন্দন গাছ চোরদের একটি সক্রিয় চক্র কাজ করছে বলে পুলিশের দাবি। যদিও বনদফতর তেমন বলছে না।
বিশ্বভারতীর ভিতর থেকে চন্দন গাছ চুরির ঘটনা অবশ্য নতুন নয়। একাধিক বার এ রকম ঘটনা ঘটতে দেখেছেন আশ্রমিকেরা। শেষ বার ২০১৩ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর রাতে বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনের ১০০ মিটারের মধ্যে উত্তরায়ণ চত্বর থেকেই চুরি যায় আস্ত দু’টি চন্দন গাছ। এ রকম একটি ‘হাই সিকিউরিটি জোন’-এ কড়া নিরাপত্তা থাকা সত্ত্বেও কী ভাবে লোহার তারের বেড়া কেটে চন্দন গাছ দু’টি চুরি গেল, সে প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি। সে নিয়ে বার বার প্রশ্ন তুলেছে বিশ্বভারতীর একাধিক মহল। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পদক চুরির পর, উত্তরায়ণের মতো এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর এলাকার থেকে, বারে বারে চুরির ঘটনায় যার পর নায় ক্ষুব্ধ প্রবীণ আশ্রমিক থেকে প্রাক্তনী এবং এলাকার বিদ্বজনেরা।
উদ্বিগ্ন বিশ্বভারতীর প্রাক্তনী অনিল কোনার। তিনি বলেন, ‘‘নিরাপত্তা আর কোথায়। গাফিলতি তো রয়েইছে। নইলে এত চুরি হয়!’’ চিকিৎসক মোহিত সাহা বলেন, ‘‘সার্বিক আইন শৃঙ্খলা যে কতটা বিপর্যস্ত, তারই প্রতিফলন। এই ঘটনা বারে বারে ঘটছে। কোনও সমাধানও দেখছি না। ফলে, দিন দিন চুরি বাড়ছে। কানের দুল থেকে এখন চন্দন চুরি!’’ প্রাক্তনী মধুমন্তী মণ্ডল বলেন, ‘‘উত্তরায়ণ চত্বর থেকে চুরি হয়েছে, লাগোয়া এলাকা থেকে, এখন বাসিন্দাদের বাড়ি থেকে চুরি হচ্ছে। পিছনে চক্র রয়েছে বলেই মনে হয়। পুলিশ উদ্যোগ নিক এখুনি।’’
বুধবারের চুরির ঘটনা প্রসঙ্গে পুলিশ ও স্থানীয় সুত্রে জানা গিয়েছে, শান্তিনিকেতনের রতনপল্লির বাসিন্দা অজিত মৈত্র বুধবার সকালে জানতে পারেন তার বাড়িতে থাকা চন্দন গাছ কে বা কারা কেটে নিয়েছে। বিষয়টি এলাকায় জানাজানি হওয়ার পর, স্থানীয় শান্তিনিকেতন তদন্ত কেন্দ্রে ঘটনার কথা লিখিত ভাবে জানান মৈত্রবাবু। জানা গিয়েছে, অজিতবাবুর বাড়ির ওই চন্দন গাছের বয়স আনুমানিক ৫০ বছর। স্থানীয় দোকানদারদের দাবি, বাজারে চন্দন কাঠ কেজি তিন হাজার টাকায় বেচাকেনা হয়। ৫০ বছরের পুরনো ওই গাছের মূল্য আনুমাণিক ৩০ লক্ষ টাকা বলে স্থানীয়দের দাবি।
এ দিকে চন্দনগাছ চুরি শুধু শান্তিনিকেতনে নয়, জেলায় বিভিন্ন এলাকায় চুরি হয়েছে গত কয়েকমাসে। কখনও খোদ জেলার বনাধিকারিকের বাংলো থেকে খোওয়া গিয়েছে চন্দন গাছ। বিশ্বভারতী ক্যাম্পাসে তো বটেই, কখনও বাসিন্দাদের বসতবাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেও চুরির ঘটনা ঘটেছে। ইদানিং চোরদের এ হেন হামলায় ক্ষোভ বাড়ছে স্থানীয়দের। প্রথা মাফিক অভিযোগ জানানোর পর, ঘটনাস্থলে আসে পুলিশ। কিন্তু হদিশ করা তো দূরের কথা, এ হেন চন্দন গাছ চুরি বা অন্য কোনও চুরির ক্ষেত্রে তাদের তদন্তের কোনও অগ্রগতিই দেখতে পাচ্ছন না স্থানীয়রা। ঘটনায় কেউ গ্রেফতারও হননি এখনও পর্যন্ত।
জানা গিয়েছে, উত্তরায়ণের লাগোয়া এলাকা শ্রীপল্লি থেকে দু’ দফায় চলতি বছর ২৬ মে এবং ২ অগস্ট চন্দন গাছ চুরি এবং চুরির চেষ্টা হয়। শুধু তাই নয়, রীতিমতো ওই চন্দন গাছের চোরেরা স্থানীয় কর্মী আবাসনে এবং বিশ্বভারতীর নিরাপত্তা কর্মীদের গুলি করার হুমকিও দিয়েছে বলে অভিযোগ। এমন ঘটনার পর যত দিন যাচ্ছে, চন্দন চোরেদের দৌরাত্মে ভীত ও সন্ত্রস্ত হচ্ছেন স্থানীয়রা। অন্যদিকে বিশ্বভারতী এলাকায় একাধিক চন্দন গাছ চুরি যাওয়ায় বিশ্বভারতীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে আরও একবার প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ আশ্রমিক থেকে পড়ুয়া এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের একটা বড় অংশই। আশ্রম এবং ঠাকুর পরিবারের দুর্মূল্য জিনিসপত্র কতটা সুরক্ষিত, সে নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বিভিন্ন মহলে। অভিযোগ, এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গার নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বড় ফাঁক থেকে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পদক চুরি যাওয়ার পরে একাধিক বার বড় চুরির ঘটনা ঘটলেও টনক নড়েনি বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের।
বিশ্বভারতীর নিরাপত্তা বিভাগ এবং পুলিশ সুত্রে জানা গিয়েছ, গত ২৬ মে বিশ্বভারতীর উত্তরায়ণ লাগোয়া এলাকা শ্রীপল্লি কর্মী আবাসন থেকে চন্দন গাছ চুরি করে পালায় দুষ্কৃতীরা। ওই রাতেই ঘটনার কথা জানাজানি হতেই, নিরাপত্তা বিভাগের লোকজন আসার আগে সামান্য কিছু টুকরো ফেলে দিয়ে চম্পট দেয় দুষ্কৃতীরা। বিশ্বভারতী সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই উত্তরায়ণ এবং তার লাগোয়া এলাকা থেকে চন্দন গাছ চুরি ও চুরির চেষ্টা বার সাতেক হয়েছে। গত পয়লা ডিসেম্বর ২০১৪ সালে চুরি গিয়েছে সিউড়িতে জেলার ডিএফও বাংলো থেকে শ্বেত চন্দনের একটি গাছ। কিনারা হয়নি তারও।
বিশ্বভারতীর নিরাপত্তা বিভাগের বর্ষীয়ান এক কর্তা এবং জেলা পুলিশের এক কর্তার কথায়, স্থানীয়দের মদতে এলাকায় চন্দন গাছ চুরির চক্র সক্রিয় হয়েছে। দুষ্কৃতীরা এহেন চুরি করার সময়ে স্থানীয় কর্মী আবাসন থেকে খবর পেয়ে, নিজস্ব নিরাপত্তা বিভাগের কর্মী এবং বহু সংখ্যক বেসরকারি নিরাপত্তা রক্ষী নিয়ে ওই এলাকায় গিয়ে বার দুয়েক তল্লাশিতে নামলেও, চুরি রোখা যায়নি। এমনকী স্থানীয় পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে তাঁরা অভিযানে নেমেছেন ঠিকই কিন্তু ধরা পড়েনি কেউ!
রবীন্দ্রনাথের নোবেল পদক চুরির পর, এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শ কাতর এলাকার থেকে, বারে বারে চুরির ঘটনায় এ দিনও ক্ষুব্ধ প্রবীণ আশ্রমিক থেকে প্রাক্তনী, এলাকার বাসিন্দারা। তাঁদের ক্ষোভ, বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ থেকে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন সকলে নির্বিকার।
ডিএফও সন্তোষা জি আর অবশ্য বলেন, ‘‘এতে কোনও চক্র নেই। স্থানীয় দু’চার জন চোরের কাজ হতে পারে। কারণ চক্র থাকলে, যে লাভের জন্য চক্র তৈরি হতে পারে সেই বড় স্কেলে এখানে চন্দন গাছ নেই। চোরেদের মুনাফাও তেমন হওয়ার কথা নয়। পুলিশকে আমরাও জানিয়েছি। দু’পক্ষই চেষ্টা করছি। এখনও কিনারা হয়নি।’’ তাঁদের কেউ চুরির কথা জানায় না, এমন বলছেন বোলপুরের রে়ঞ্জারও।
জেলা পুলিশ সুপার মুকেশ কুমারকে বিষয়টি নিয়ে জানতে ফোন করা হলে, তিনি ফোন ধরেননি। এসএমএসেরও কোনও উত্তর দেননি।
সহ প্রতিবেদন: দয়াল সেনগুপ্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy