Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

রাষ্ট্রপুঞ্জে বাল্য বিবাহের যন্ত্রণা শোনালেন সাঁওতাল বধূ

মাঝপথেই থমকে গিয়েছিল পড়াশোনা। অলচিকি হরফটা যখন কোনও মতে চিনতে শিখছে, সেই সময়েই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল তাঁর। প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও, সেই কিশোরবেলায় সংসারের জাঁতাকলে আষ্টেপৃষ্টে আটকে পড়েছিল মেয়েটি। ষোলো বছরেই দুই মেয়ের মা হয়ে আদিবাসী জীবনের আটপৌরে অনুশাসনে বাঁধা পড়েছিলেন সান্ত্বনা মুর্মু।

স্ট্যাচু অফ লিবার্টির সামনে সান্ত্বনা। নিজস্ব চিত্র।

স্ট্যাচু অফ লিবার্টির সামনে সান্ত্বনা। নিজস্ব চিত্র।

রাজীবাক্ষ রক্ষিত ও অনুপরতন মোহান্ত
কলকাতা ও বালুরঘাট শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:১৮
Share: Save:

মাঝপথেই থমকে গিয়েছিল পড়াশোনা। অলচিকি হরফটা যখন কোনও মতে চিনতে শিখছে, সেই সময়েই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল তাঁর। প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও, সেই কিশোরবেলায় সংসারের জাঁতাকলে আষ্টেপৃষ্টে আটকে পড়েছিল মেয়েটি। ষোলো বছরেই দুই মেয়ের মা হয়ে আদিবাসী জীবনের আটপৌরে অনুশাসনে বাঁধা পড়েছিলেন সান্ত্বনা মুর্মু।

দক্ষিণ দিনাজপুরের প্রান্তিক গ্রাম সুবর্ণপুরে সদ্য-তরুণীর প্রথম জীবনের এই ঢিলেঢালা দিন যাপনের ছবিটাই আমূল বদলে গিয়েছিল এক বছরে— নিউইয়র্কে রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিপূর্ণ সভাঘর, ঝকঝকে আবহে নিরন্তর ইংরাজির ফুলঝুরির মাঝে অবলীলায় নিজের চেনা সাঁওতালি ভাষায় বক্তৃতা, হাততালি এমনকী নোবেলজয়ী কৈলাশ সত্যার্থীর সঙ্গে বৈঠক সেরে সান্ত্বনা বলছেন, ‘‘মনে হচ্ছে, সামনে থেকে কুয়াশা কেটে গেল!’’ যে মেয়ে গ্রামের বাইরে পা-ই রাখেননি তাঁর সমুদ্র-পাড়ি দেওয়ার এই গল্পটা কী?

আদিবাসী গ্রামের মেয়েটির বড় সাধ ছিল ‘ইস্কুলের দিদিমণি’ হওয়ার। কিন্তু, বাড়ির চাপে দিন মজুর গোবিন্দ হেমব্রমের সঙ্গে বিয়ের
পরে অষ্টম শ্রেণিতেই থমকে গিয়েছিল তাঁর পঠন-পাঠন।
তবে পড়ার সুযোগ থমকে গেলেও বন্ধ হয়নি স্বপ্নের দৌড়। সান্ত্বনা বলছেন, ‘‘নিজেকে বলতাম— নিজে পারিনি, কিন্তু মেয়ে দু’টোকে দিদিমণি করতেই হবে!’’ শখ করে, পুরনো পাঠ্য বই ঘেঁটে মেয়েদের নাম রেখেছিলেন বৃষ্টি আর বসুন্ধরা।

এই অদম্য জেদের মধ্যেই গত বছর তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় দুই ‘দিদির’। গ্রামে বাল্য বিবাহ রুখতে প্রচারে আসা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ওই দুই মহিলার হাত ধরেই অতঃপর বাইরের দুনিয়ার দুয়ার খুলে গিয়েছিল সান্ত্বনার। প্রথমে চুপ করে ওই ‘দিদি’দের কথা শুনতেন, তার পর, এক দিন এগিয়ে এসেছিলেন নিজেই। গ্রামের মেয়েদের মধ্যে দাঁড়িয়ে সটান ঘোষণা করেছিলেন, ‘‘আমার সঙ্গে যা হয়েছে তা যেন অন্যদের না হয়। আঠারো বছর বয়স না হলে কোনও মতেই বিয়ে নয়।’’ ওই সংগঠনের কর্মীরা তাঁকে নিয়েই বাল্য বিবাহ রুখতে শুরু করেছিলেন প্রচার।

ওই সতেরো বছরেই আরও একটা লড়াই শুরু হয়েছিল তাঁর— আদিবাসী সমাজের সঙ্গে। বলছেন, ‘‘আদিবাসী সমাজ রুখে দাঁড়িয়েছিল আমার বিরুদ্ধে। গ্রামের মোড়ল হুমকি দিয়েছিলেন, এক ঘরে করে দেওয়ার। তবে আমি ভয় পাইনি।’’ আর, এই লড়াইয়ে সান্ত্বনা পাশে পেয়ে গিয়েছিলেন তাঁর স্বামীকে। বলছেন, ‘‘ওটাই ছিল আমার বড় ভরসা।’’

ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষে সুজয় রায় বলছেন, ‘‘ওই বয়সেই মেয়েটির পরিণত মন আর তেজ দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কারও বাড়িতে বাল্য বিবাহের খবর পেলেই ছুটে গিয়ে বাধা দিতেন।
নালিশ ঠুকতেন পঞ্চায়েতে। গ্রামের মেয়েদের নিয়ে বৈঠক করে বোঝাতেন বাল্য বিবাহের পরিণতি।’’ বাল্য বিবাহ নিয়ে একটি তথ্যচিত্রেও সোজা সাপটা প্রশ্ন তুলে দিয়েছিলেন তিনি—‘‘স্বাস্থ্য মিশনে মেয়েদের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে,
অথচ প্রকল্পের রূপরেখা তৈরিতে মেয়েদের-মায়েদের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে কোথায়?’’

কুশমণ্ডির সুবর্ণপুরে নিজের বাড়িতে। ছবি: অমিত মোহান্ত।

তথ্যচিত্রটা দেখেছিলেন হু-এর ‘ওয়ার্ল্ড হেল্থ অ্যাসেমব্লি’র কর্তারা। ছবিতে সান্ত্বনার ওই প্রশ্নটা চমকে দিয়েছিল তাঁদের। খোঁজ পড়েছিল মেয়েটির। দিন কয়েকের মধ্যেই সুবর্ণপুর গ্রামে উড়ে এসেছিল রাষ্ট্রপুঞ্জের চিঠি।

কিন্তু সে চিঠিতে খুশি দূরে থাক বেঁকে বসেছিল সুবর্ণপুর। সাত-সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ঘরের বউ যাবে বিদেশে, তা আবার হয় নাকি?

মেয়ের যাত্রা ঠেকাতে নিজের বাবা-মা লুকিয়ে রেখেছিলেন তাঁর পাসপোর্ট। হাসতে হাসতে সান্ত্বনা বলছেন, ‘‘খড়ের গাদায় লুকিয়ে ফেলা হয়েছিল ভোটার কার্ড।’’

তবে রাষ্ট্রপুঞ্জ ফেরত সান্ত্বনার জীবন বদলায়নি। বুধবার ভাঙা টিনের ছাউনির নিচে কচু সেদ্ধ করার ফাঁকে সান্ত্বনা বলছেন, ‘‘বিদেশ যাওয়ার খরচ তো জোগালেন সুজয়বাবুরা, কিন্তু আমার তো ভাল শাড়ি-গরম পোশাক কিছুই ছিল না।’’ সবই পড়শিরদের কাছে টাকা ধার করে কিনতে হয়েছিল তাঁকে।

পাড়া-পড়শি তাঁর লড়াইয়ের কথা জানেন, কিন্তু কুশমন্ডি ব্লকের কর্তা থেকে শাসক দলের স্থানীয় নেতারা কেউ-ই খোঁজ রাখেননি। তৃণমূলের ব্লক চেয়ারম্যান সুনির্মলজ্যোতি বিশ্বাস বলছেন, ‘‘নাঃ, ওই নামে কাউকে চিনি না।’’ জেলার আদিবাসী নেতা তথা জেলাপরিষদের কর্মাধ্যক্ষ বিশ্বনাথ পাহান মাছি তাড়ানোর মতো উড়িয়ে দিচ্ছেন, ‘‘সান্ত্বনা বলে সুবর্ণপুরের কেউ রাষ্ট্রপুঞ্জে গিয়েছিল বলে তো শুনিনি।’’

সান্ত্বনা অবশ্য নাছোড় অভাবের মতোই চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁর লড়াই। বলছেন, ‘‘নেতারা আমায় না চিনুক ক্ষতি নেই, গ্রামের মেয়েরা আমার কথা শুনলেই হল!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE