Advertisement
১৮ মে ২০২৪
সারদা তদন্ত

নথি লোপাট করতেই কি অফিস ভাঙচুর

২০১৩ সালের ২০ এপ্রিলের ঘটনা। তখনও ফেরার সুদীপ্ত সেন। মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে একটি হোটেলের তিনতলায় সারদার অফিসে ভাঙচুর চালালেন প্রতারিত আমানতকারীরা। একই দিনে পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল বাজারে সারদার অফিসেও ভাঙচুর চলল। অফিসের নথি, কম্পিউটার লুঠ করা হল। দু’টো ঘটনায় মিল একটাই। এক থেকে দেড় ঘণ্টা ধরে গণ্ডগোল চললেও পুলিশের দেখা মেলেনি।

প্রেমাংশু চৌধুরী
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:০৮
Share: Save:

২০১৩ সালের ২০ এপ্রিলের ঘটনা। তখনও ফেরার সুদীপ্ত সেন। মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে একটি হোটেলের তিনতলায় সারদার অফিসে ভাঙচুর চালালেন প্রতারিত আমানতকারীরা। একই দিনে পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল বাজারে সারদার অফিসেও ভাঙচুর চলল। অফিসের নথি, কম্পিউটার লুঠ করা হল।

দু’টো ঘটনায় মিল একটাই। এক থেকে দেড় ঘণ্টা ধরে গণ্ডগোল চললেও পুলিশের দেখা মেলেনি।

ওই ঘটনার দু-তিন দিনের মধ্যেই কাশ্মীরের সোনমার্গে গ্রেফতার হন সুদীপ্ত। তার আগে ও পরে, ২০১৩-র গোটা এপ্রিল ও মে মাস জুড়েই বিক্ষিপ্ত ভাবে ভাঙচুর ও হামলার ঘটনা ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় সারদার শাখা অফিসগুলিতে।

এই ভাঙচুর-লুঠতরাজের আড়ালে সারদার অফিস থেকে গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র লোপাট করে দেওয়া হয়েছিল কি না, এ বার তা খতিয়ে দেখছে সিবিআই। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা মনে করছেন, এই ধরনের বেশ কিছু নথি প্রকাশ্যে এলে সারদার সঙ্গে তৃণমূল নেতৃত্বের যোগাযোগ অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে যেত।

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সিবিআই তদন্তভার হাতে নেওয়ার আগে পর্যন্ত রাজ্য পুলিশ সারদার তদন্ত করছিল। সেই সংক্রান্ত নথিপত্র তারা ইতিমধ্যেই সিবিআইকে হস্তান্তর করেছে। কিন্তু সিবিআইয়ের বক্তব্য, বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি এখনও নিখোঁজ। সারদার বিভিন্ন শাখা অফিসে ভাঙচুর করিয়ে ওই সব নথি লোপাটের ‘ষড়যন্ত্রে’র পিছনে শাসক দলের নেতাদেরই মস্তিষ্ক কাজ করেছে বলে সন্দেহ করছেন তদন্তকারীরা।

কী ধরনের নথি লোপাট হয়েছে বলে মনে করছে সিবিআই? সূত্রের দাবি, মূলত হিসেব-নিকেশের খাতা এবং নিয়োগ সংক্রান্ত নথি। এ ছাড়া, সারদা সংস্থা যে সব সম্পত্তি কিনেছিল বা ভাড়া নিয়েছিল, বেশ কিছু ক্ষেত্রে তারও নথি মিলছে না।

সাধারণ যুক্তি বলছে, সারদার বিভিন্ন শাখা অফিসে হিসেব-নিকেশের খাতা ও এজেন্টদের নিয়োগ সংক্রান্ত কাগজপত্র থাকার কথা। অথচ অনেক ক্ষেত্রেই তা পাওয়া যাচ্ছে না। রাজ্য পুলিশের থেকেও এ সব নথি মেলেনি। ফলে তদন্তে বাধা পড়ছে। রাজ্য পুলিশের এক কর্তার অবশ্য দাবি, “গোটা পশ্চিমবঙ্গে সারদার ১৬০টি শাখা অফিসের কোনওটিতেই হিসেবের খাতা ছিল না। সব হিসেব-নিকেশ কম্পিউটার সফ্টওয়্যারেই হতো।” কিন্তু সিবিআইয়ের প্রশ্ন, সফ্টওয়্যারে হিসেব-নিকেশ হলেও কিছু ফাইল থাকবেই। সে সব কোথায় গেল? তা ছাড়া, সারদা যে সব সম্পত্তি কিনেছিল, তা বিশেষ কারও কাছ থেকে কিনতে তাদের বাধ্য করা হয়েছিল কি না, তা-ও খতিয়ে দেখতে চাইছে সিবিআই। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও বেপাত্তা বেশ কিছু নথি।

এর পর ধরা যাক নিয়োগ সংক্রান্ত কাগজপত্র। তদন্তকারীরা জেনেছেন, সারদার ১৬০টি শাখা অফিসে যে সব এজেন্ট বা কর্মচারীকে নিয়োগ করা হয়েছিল, তাঁদের অনেকেই তৃণমূলের কর্মী বা সমর্থক। কোনও ক্ষেত্রে স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের সুপারিশে তাঁদের নিয়োগ করা হয়েছিল। কোথাও আবার তৃণমূল নেতারা নিজেরাই সারদার এজেন্ট ছিলেন বলে প্রমাণ মিলেছে।

গোয়েন্দাদের সন্দেহ, সুদীপ্ত সেন গা ঢাকা দেওয়ার পর সারদার সঙ্গে শাসক দলের নেতাদের এমনই নানা ‘যোগসূত্রের’ প্রমাণ লোপাট করাটা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। আর সেই কারণেই সারদার অফিসে প্রতারিতদের বিক্ষোভ-ভাঙচুরের আড়ালে তথ্যপ্রমাণ লোপাট করা হয়ে থাকতে পারে। এমনকী পরিকল্পিত ভাবে ভাঙচুর চালানো হয়েছিল কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

এ বিষয়ে তৃণমূলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েনকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আপনাদের স্বনামধন্য পত্রিকা সব সময় যা লিখে থাকে, তা-ই লিখুন। এর বেশি আমি আর কী বলব?”

নথিপত্র লোপাটের পিছনে রাজ্য পুলিশের হাত থাকার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছে না সিবিআই। সংস্থা সূত্রের দাবি, রাজ্য প্রশাসন ও শাসক দলের নির্দেশে পুলিশকর্তাদের তথ্যপ্রমাণ লোপাটে বাধ্য করা হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু অন্যান্য সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখা জরুরি। সারদার কর্মীদেরও এ কাজে লাগানো হয়েছিল কি না, তা-ও তদন্ত করে দেখা হবে।

ভাঙচুর ও নথি লোপাটের তদন্তে কী ভাবে এগোচ্ছে সিবিআই? প্রথমত, সারদার বিভিন্ন অফিসে ভাঙচুরের পরে থানায় যে সব মামলা হয়েছে, সেগুলি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ওই সব মামলায় কাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তাঁদের পরিচয়ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সমস্যা হল, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই ধরনের অভিযোগও করা হয়নি। পুলিশের খাতায় ভাঙচুরের যে বর্ণনা রয়েছে, তাতেও অনেক জায়গায় নির্দিষ্ট কোনও ব্যক্তির নাম নেই। ফলে তদন্ত করতে গিয়ে সিবিআই অফিসারেরা বুঝছেন, প্রায় সব জায়গাতেই পুলিশ ভাঙচুরের অনেক পরে গিয়ে পৌঁছেছিল। এই দেরিতে পৌঁছনোর ক্ষেত্রেও শাসক দলের নেতাদের প্রচ্ছন্ন ‘নির্দেশ’ ছিল বলে সন্দেহ করছে সিবিআই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE