মনে পড়ে ‘আ বিউটিফুল মাইন্ড’ ছবিটির গণিতবিদ জন ন্যাশের কথা? অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী এই গণিতবিদ কিন্তু স্কিৎজ়োফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্ত ছিলেন!
স্কিৎজ়োফ্রেনিয়া এমন এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা, যা মানুষের ভাবনা, অনুভূতি ও বাস্তবতা বুঝে নেওয়ার ক্ষমতা অনেকাংশেই কমিয়ে দেয়। কেউ হয়তো মনে করেন, এক জন তাঁর পিছনে লেগেছেন, কারও কানে অদ্ভুত শব্দ আসে, কেউ আবার অদ্ভুত কথা বলেন বা এমন কিছু বিশ্বাস করেন, যা বাস্তবে নেই। এর ফলে অনেক সময়ে পরিবার, বন্ধু বা সমাজ থেকে দূরত্ব তৈরি হয় সেই মানুষটির। একে ‘পাগলামি’ বলে উড়িয়ে দেওয়া একেবারে ভুল হবে।
বিশ্ব স্কিৎজ়োফ্রেনিয়া সচেতনতা দিবস প্রতি বছর ২৪ মে পালিত হয়। এর মূল উদ্দেশ্য হল, স্কিৎজ়োফ্রেনিয়া নামের এক জটিল, অথচ চিকিৎসাযোগ্য মানসিক অসুস্থতা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো, ভুল ধারণা দূর করা এবং আক্রান্তদের প্রতি সহানুভূতি বাড়ানো।
এই অসুস্থতা কোনও নির্দিষ্ট শ্রেণি বা বয়সের মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী থেকে মধ্যবয়সি পুরুষ-মহিলা— যে কেউ এই অসুখে আক্রান্ত হতে পারেন। সাধারণত, ১৬ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে এই অসুস্থতার লক্ষণগুলি প্রথম ধরা পড়ে। প্রাথমিক ভাবে লক্ষ করা যায়, আচরণে পরিবর্তন, একাকিত্ব, অদ্ভুত বিশ্বাস, পড়াশোনা বা কাজে মন না বসা, ঘুমের সমস্যা, আত্মবিশ্বাসের অভাব কিংবা কারও প্রতি সন্দেহ। পরিবারের কেউ যদি এমন পরিবর্তন লক্ষ করেন, তবে তা অবহেলা না করে মনোরোগ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
স্কিৎজ়োফ্রেনিয়ার চিকিৎসা এখন অনেক উন্নত। নিয়মিত ও দীর্ঘমেয়াদি ওষুধ, কাউন্সেলিং এবং পরিবারের সহানুভূতি— এই তিনটি মিলে রোগীকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে দেওয়া যায়। অনেকেই ভেবে থাকেন, এই রোগ হলে জীবনে আর কিছু করা যায় না— এই ধারণা একেবারে ভুল! বহু মানুষ স্কিৎজ়োফ্রেনিয়া থেকে সুস্থ হয়ে আবার পড়াশোনা করেছেন, চাকরি করেছেন, সংসার করেছেন। যেমন ধরুন, কলকাতার মধুমিতার (নাম পরিবর্তিত) কলেজে পড়ার সময় থেকে আচরণে অদ্ভুত পরিবর্তন আসে। কল্পনার জগতে হারিয়ে যাওয়ায় এবং সকলের থেকে দূরে সরে যাওয়ায় ধীরে ধীরে তাঁর
জীবন থমকে গিয়েছিল। কিন্তু উপযুক্ত চিকিৎসা, ওষুধ, মনোবিজ্ঞানী ও পরিবারের সহযোগিতায় তিনি আজ সুস্থ। এখন একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন ও অন্যদের সাহায্য
করেন, যাঁরা এই অসুখের সঙ্গে লড়াই করছেন।
এই রোগ দেখা দিলে রোগী ও তাঁদের পরিবারের কষ্ট তো আছেই। তার চেয়েও বেশি দুর্ভাগ্যজনক হল, রোগীদের ব্যাপারে সমাজের ভুল দৃষ্টিভঙ্গি। বহু সিনেমা, সিরিয়ালে দেখানো হয়— স্কিৎজ়োফ্রেনিয়া আক্রান্ত মানে ‘পাগল’, ‘হিংস্র’, ‘অদ্ভুত কাণ্ড’ করা এক মানুষের ছবি। তাঁরা অন্ধকারে থাকেন, তাঁদের বেঁধে রাখা হয় ইত্যাদি। কিছু হিন্দি ও আঞ্চলিক সিনেমায় স্কিৎজ়োফ্রেনিয়া রোগীদের এমনই বিকৃত ভাবে দেখানো হয়েছে, যা জনমানসে এই রোগ সম্পর্কে আতঙ্ক তৈরি করে এবং আক্রান্ত ও তাঁদের পরিবারকে সমাজে আরও একা করে দেয়।
অনেকে মনে করেন, এই রোগীরা বিপজ্জনক, অথচ, বাস্তবে স্কিৎজ়োফ্রেনিয়া আক্রান্ত মানুষদের বড় অংশই শান্তশিষ্ট, অভ্যন্তরীণ যন্ত্রণা নিয়ে সাহায্যের অপেক্ষায় থাকা এক মানুষ। তাঁদের প্রতি সমাজের সহানুভূতি ও মানবিকতা বোধ থাকা খুবই জরুরি। আমরা যত দিন না এই ভুলগুলিকে প্রশ্ন করব, তত দিন মানসিক রোগ মানেই পাগল, মানসিক রোগ মানেই সমাজচ্যুত— এই মানসিকতা বজায় থাকবে। বাস্তব হল, ডায়াবিটিস বা উচ্চ রক্তচাপের মতোই স্কিৎজ়োফ্রেনিয়া একটি অসুস্থতা। তফাত শুধু এটাই যে, এটি মনের অসুস্থতা। তাই চিকিৎসা, সহানুভূতি ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতাই এর মূল চিকিৎসা।
বরং আমরা সকলে একসঙ্গে এই প্রতিজ্ঞা করি— মানসিক অসুস্থতাকে লুকোব না, লজ্জা পাব না এবং সমাজে আক্রান্তদের জন্য জায়গা করে দেব। প্রত্যেকের জীবনেরই মূল্য আছে। মনে রাখবেন, সাহায্য পাওয়া যায়। শুধু খুঁজে নিতে হয় ঠিক পথ। আশা, সাহস আর চিকিৎসা— এই তিনটির ভরসায় স্কিৎজ়োফ্রেনিয়া থেকেও মানুষ আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারেন।
মনোরোগ চিকিৎসক
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)