Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
মেয়েদের হাতে মুক্তির মশাল

স্কুলছুটদের ফেরাচ্ছে ওরা

স্কুলছুটির পরে বিকেল হোক বা ছুটির দিনের সকাল— সময় পেলেই বেরিয়ে পড়ছে মেয়ের দল।

পুরুলিয়ায় বিজলি সিংহের বাড়িতে কন্যাশ্রী ক্লাবের মেয়েরা। প্রদীপ মাহাতোর তোলা ছবি।

পুরুলিয়ায় বিজলি সিংহের বাড়িতে কন্যাশ্রী ক্লাবের মেয়েরা। প্রদীপ মাহাতোর তোলা ছবি।

সমীর দত্ত
মানবাজার শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০১৬ ০৩:৫৪
Share: Save:

স্কুলছুটির পরে বিকেল হোক বা ছুটির দিনের সকাল— সময় পেলেই বেরিয়ে পড়ছে মেয়ের দল। কমলা-সাদা সালোয়ার-কামিজের সঙ্গে কাঁচা হাতের লেখায় পোস্টার— ‘নাবালিকা বিয়ে মানছি না, মানব না’। পথে-ঘাটে লোকজন দেখলেই তারা স্লোগান দিচ্ছে, ‘‘নাবালিকা মেয়ের বিয়ে দেবেন না। তাকে স্কুলে পাঠান।’’

ঠিকানা, পুরুলিয়ার মানবাজার ২ ব্লকের বসন্তপুর আদিবাসী হাইস্কুল। অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির প্রায় ৭০ জন পড়ুয়া জুলাই মাস থেকে শুরু করেছে ‘চেতনার আলো কন্যাশ্রী ক্লাব’। আশপাশের গ্রামে ঘুরে সচেতনতার পাঠ দিচ্ছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে বোঝাচ্ছে, মেয়েরা স্কুলে গেলে পড়াশোনা শিখবে, সুবিধা পাবে কন্যাশ্রী প্রকল্পেরও।

বসন্তপুর আদিবাসী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক অজয়কুমার মাহাতো জানান, সম্প্রতি এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা স্কুলে এসে এই ক্লাব তৈরির কথা পেড়েছিল। সংস্থার তরফে বিপ্লব মুখোপাধ্যায় জানান, যারা কন্যাশ্রী প্রকল্পে নাম লেখাচ্ছে তাদের অনেকেই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চায়। এই মেয়েগুলোকে এক ছাতার তলায় আনতে পারলে নাবালিকাদের বিয়ে রোখার প্রচারে জোয়ার আনা সম্ভব। পুরুলিয়ার অন্তত ১০টি ব্লকে বিভিন্ন স্কুলে তাঁরা এই ক্লাব গড়ার প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছেন। তবে বসন্তপুর আদিবাসী হাইস্কুল ছাড়া অন্য ক্লাবের সদস্যেরা এখনও রাস্তায় নামেনি।

বসন্তপুরের ছাত্রীরা এখন নিজেরাই খোঁজ করে স্কুলছুট মেয়েদের স্কুলে ফেরাচ্ছে। সেই সঙ্গে বাল্যবিবাহের কুফল, শিশু-শ্রম বন্ধে প্রচার এবং স্বাস্থ্যবিধির পাঠও দিচ্ছে তারা। সঙ্গে কিছু শিক্ষক থাকছেন। অজয়বাবু বলেন, ‘‘এই ক’দিনেই ওরা দুই স্কুলছুট ছাত্রীকে ফিরিয়ে এনেছে।’’

দিন কয়েক আগেই আগে স্কুলে টিফিনের অবসরে শুচিস্মিতা, পল্লবী, রোজিনা, মৌসুমিরা চিরুগোড়া গ্রামে গিয়েছিল কাজলি আর বিজলির জন্য। ওই দুই বোন বছর তিনেক ধরে স্কুলে আসছে না। কাজলি-বিজলির মা জ্যোৎস্না সিংহের কাছে মেয়েরা জানতে চাইল, ‘‘কাকিমা ওরা স্কুল যাচ্ছে না কেন?’’ মহিলা বললেন, দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিল কাজলি। তাই স্কুলে যায়নি। বোনকে বাড়িতে রেখে স্কুলমুখো হতে চায়নি বিজলিও। ক্লাব সদস্যেরা জ্যোৎস্নাদেবীকে বোঝায়, মেয়েদের স্কুলে পাঠান। তখন আবার দুই বোনের সঙ্কোচ— ‘‘এত দিন পরে স্কুলে গেলে দিদিমণি, স্যারেরা কী বলবেন! যদি কেউ বকেন?’’ কন্যাশ্রী ক্লাবের চটজলদি নিদান, ‘‘আমরাই তোদের সঙ্গে নিয়ে স্কুলে যাব। কেউ কিচ্ছু বলবে না, দেখিস।’’

নাবালিকা বিবাহ রোধে রাজ্যে এক সময় প্রচারের মুখ হয়ে উঠেছিল পুরুলিয়ারই বীণা কালিন্দী, আফসানা খাতুনরা। এখনও তবে রেজিনা, মৌসুমিদের পথে নামতে হচ্ছে কেন? কন্যাশ্রীর প্রচারের দায়িত্বই বা কেন নিতে হচ্ছে? প্রশাসন সূত্রের খবর, ২০১৫-’১৬ অর্থবর্ষে মানবাজার ২ ব্লকে সাত নাবালিকার বিয়ে রোখা হয়েছে। তার মধ্যে দু’জন কন্যাশ্রীর তালিকাভুক্ত। ‘চাইল্ড লাইন’-এর পুরুলিয়া জেলা আহ্বায়ক দীপঙ্কর সরকার জানাচ্ছেন, বছরে জেলায় ৬০-৭০টি বিয়ে বন্ধ করা গেলেও, অনেক বিয়ের খবর তাঁরা পানও না। সেই পরিস্থিতিতে এই ক্লাব সক্রিয় হলে সচেতনতা-প্রচারে জোর বাড়বে। জেলা সমাজকল্যাণ আধিকারিক নীলিমা দাস চৌধুরীও মানছেন, ‘‘প্রশাসন যথাসাধ্য প্রচার চালাচ্ছে। এই কিশোরীদের আন্তরিকতায় বাকি ফাঁকটুকু ভরে যাবে।’’

ভরছেও। মেয়েদের কথা শুনে গৃহবধূ প্রমীলা হাঁসদা, অঞ্জলি মুর্মুরা বলছেন, ‘‘লেখাপড়ায় আমরাও খারাপ ছিলাম না। কিন্তু অল্প বয়সে বিয়ের পরে সংসারের চাপে স্বপ্নগুলো সত্যি হয়নি। মেয়ের বেলায় তেমন হবে না।’’ আবার চিরুগোড়া গ্রামে এক প্রৌঢ়া ওদের শুনিয়েছেন, ‘‘মেয়ের জন্য পরে পাত্র না মিললে, তোমরা খুঁজে দেবে?’’ সঙ্গে থাকা স্কুল-শিক্ষক সব্যসাচী রজক এবং বশির মল্লিক ওই প্রৌঢ়াকে বুঝিয়েছেন— ১৮ বছরের নীচে মেয়ের বিয়ে দিলে সাজা হতে পারে বাবা-মারও। মাস্টারমশাইয়েরা বলেছেন, ‘‘পাত্রপক্ষের যদি মেয়েকে পছন্দ হয়েই থাকে তা হলে তারা ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করবে।’’

পল্লবী, রোজিনারাও খুশি। ওরা বলছে, ‘‘আমাদের কথা শুনে যদি আরও কেউ স্কুলে আসে, তার চেয়ে বেশি কিছু আমাদের পাওয়ার নেই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Child marriage
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE