Advertisement
E-Paper

মিড-ডে মিলেও ছুটি, পড়ুয়ারা ফিরবে তো

স্কুলে ঝাঁপ পড়েছে। ক্লাসের সামনে দাওয়ায় সারি দিয়ে বসে দুপুরের খাওয়া সারার পাটও চুকেছে দু’মাসের জন্য। গরিবগুর্বো ছেলে-মেয়েগুলো শেষে স্কুলের রাস্তা বিলকুল ভুলে যাবে না তো? রাজ্যে স্কুলশিক্ষা যে ভাবে ছুটিতে মজেছে, তাতে সিলেবাস নিয়ে শিক্ষকদের চিন্তার শেষ নেই। উদ্বেগের পারদ আরও চড়েছে টানা দু’মাস মিড-ডে মিল বন্ধ থাকায়। শিক্ষক মহলের বড় অংশের বক্তব্য: দিন-আনি-দিন-খাই পরিবারের বহু বাচ্চা মূলত খাওয়ার টানে স্কুলে আসে। নিখরচায় পেট ভরানোর সুযোগটা এত দিন হাতছাড়া থাকলে অনেকে ফের স্কুলছুট হয়ে পড়তে পারে।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৬ ০৩:৫৫

স্কুলে ঝাঁপ পড়েছে। ক্লাসের সামনে দাওয়ায় সারি

দিয়ে বসে দুপুরের খাওয়া সারার পাটও চুকেছে দু’মাসের জন্য। গরিবগুর্বো ছেলে-মেয়েগুলো শেষে স্কুলের রাস্তা বিলকুল ভুলে যাবে না তো?

রাজ্যে স্কুলশিক্ষা যে ভাবে ছুটিতে মজেছে, তাতে সিলেবাস নিয়ে শিক্ষকদের চিন্তার শেষ নেই। উদ্বেগের পারদ আরও চড়েছে টানা দু’মাস মিড-ডে মিল বন্ধ থাকায়। শিক্ষক মহলের বড় অংশের বক্তব্য: দিন-আনি-দিন-খাই পরিবারের বহু বাচ্চা মূলত খাওয়ার টানে স্কুলে আসে। নিখরচায় পেট ভরানোর সুযোগটা এত দিন হাতছাড়া থাকলে অনেকে ফের স্কুলছুট হয়ে পড়তে পারে।

তাপপ্রবাহের জেরে ১১ এপ্রিল থেকে পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত সরকারি ও সরকারপোষিত স্কুলে ছুটি ঘোষণা হয়েছিল। ক’দিন বাদে তাপপ্রবাহ বিদায় নিলেও ছুটিতে দাঁড়ি পড়েনি। উল্টে সিলেবাস শেষের তাগিদে ক্লাস চালু রেখে শো-কজের গুঁতো খেয়েছে কিছু স্কুল। পঁয়ত্রিশ দিনের সেই ‘প্রাক্‌ গ্রীষ্ম’ অবকাশ কাটিয়ে সোমবার স্কুল খুলেছে, তবে স্রেফ তিন দিনের জন্য। কাল, বৃহস্পতিবার থেকে পড়ে যাচ্ছে গ্রীষ্মাবকাশ— তিন সপ্তাহ।

অর্থাৎ কার্যত টানা দু’মাস ক্লাস শিকেয়, সঙ্গে মিড ডে মিলও। গ্রাম-গঞ্জে যেখানে অধিকাংশ স্কুলে খাওয়ার টোপ দিয়ে পড়ুয়া ডাকতে হয়, সেখানে এটা যেন অশনি সঙ্কেত। ‘‘অনেক বাচ্চাকে বাড়ির লোকই বাইরে কাজ করতে পাঠাতে চায়। খাবার দিয়ে ধরে রাখতে হয়। এ বার হয়তো ওরা আর স্কুলমুখোই হবে না।’’— আশঙ্কা বীরভূমের নানুর অন্নপূর্ণা কালী বিদ্যামন্দিরের শিক্ষক অবনী মণ্ডলের। পশ্চিম মেদিনীপুরে শালবনির ভাদুতলা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক অমিতেশ চৌধুরীর পর্যবেক্ষণ, “খাবারের টানেই হোক বা যাতেই হোক, অনেকের মধ্যে স্কুলে আসার অভ্যেস গড়ে উঠেছিল। এটা বড় ব্যাপার। লম্বা ছুটিতে কেউ কেউ সে অভ্যেস থেকে দূরে সরে যেতে পারে।”

রাজ্য সর্বশিক্ষা মিশনের সর্বশেষ রিপোর্ট (২০১৪-১৫) বলছে, পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ৯৯.৭% পড়ুয়া মিড-ডে মিলের আওতায়। প্রকল্পের সুবাদে রাজ্য জুড়ে স্কুলছুটের সংখ্যা কমছে হু-হু করে। কিন্তু ছুটির দাপটে সাফল্যের ছবিটা ফিকে হয়ে যাবে বলে অনেকের ধারণা। ‘‘ফের বাচ্চাদের স্কুলে আনতে আমাদের কালঘাম ছুটে যাবে।’’— মন্তব্য করেছেন পুরুলিয়ার বান্দোয়ান বিদ্যাসাগর শিক্ষানিকেতনের শিক্ষক অসীম দে। নদিয়ার মাটিয়াড়ি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক রাজীব মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘খবর পেয়েছি, বেশ কিছু ছাত্র ইতিমধ্যে নানা কাজে লেগে পড়েছে। জানি না, ওরা ফিরবে কি না।’’

গরমের ছুটি তো ফি বছর থাকে। তখনও মিড-ডে মিল মেলে না। তাতে কি পড়ুয়ারা স্কুল থেকে মুখ ফেরায়?

শিক্ষকদের একাংশের দাবি, এ বার পরিস্থিতি ভিন্ন। ওঁদের যুক্তি— গরমের ছুটি তিন সপ্তাহ। টানা দু’মাস ক্লাস বন্ধ থাকে না। ‘‘যাদের খাবারের টোপ দিয়ে স্কুলে আনতে হয়, তাদের কাছে দু’মাস সময়টা কিন্তু অনেক।’’— মন্তব্য এক শিক্ষকের।

শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য দাবি করেছিলেন, লম্বা ছুটির কোনও বিরূপ প্রভাব পড়বে না। ‘‘বাড়িতে খেলাধুলো করার জন্য ছুটি দেওয়া হয়নি। ছুটিতে পড়াশোনাও করতে হয়।’’— বলেছিলেন মন্ত্রী। প্রান্তিক পরিবারের ছেলেমেয়েদের কথা কি তাঁর মাথায় ছিল?

প্রশ্নটা উঠছে। কারণ, দিকে দিকে তেমন নমুনা ছড়িয়ে। যেমন, হাওড়া জেলার হাটবাউড়িয়া প্রাথমিক
স্কুলের ক্লাস থ্রি-র ছাত্রীটি। স্কুল বন্ধ, তাই বাড়িতেই খাওয়া। অগত্যা মেয়েকে জরির কাজে জোগাড়ে হিসেবে লাগিয়ে দিয়েছেন রিকশাচালক বাবা। মন্ত্রী যে বলেছেন ছুটিতে পড়াশোনা করতে হবে?

বাবার জবাব, ‘‘খাওয়ানোর টাকা কোথায়? পেটের টানেই মায়ের সঙ্গে ওকে কাজে পাঠাতে হচ্ছে।’’

আবার চিত্তরঞ্জনের ঘনশ্যামের কথা ধরা যাক। নিরক্ষর পরিবারে সেই প্রথম স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। লম্বা ছুটিতে ক্লাস ওয়ানের ছাত্রটিকে বাবা রোজ নিয়ে যাচ্ছেন খাদানের কাজে। ‘‘এটা-ওটা এগিয়ে দেবে। দুপুরের খাওয়ার খরচটা উঠে যাবে।’’— বলছেন বাবা। মগরা উচ্চবিদ্যালয়ের ক্লাস ফাইভের জয় কর্মকারের বাবা দিনমজুর। তাঁর বক্তব্য, “খাবার দেয় বলেই স্কুলে পাঠাই। এমন ছুটি চললে বাধ্য হয়ে স্কুল ছাড়িয়ে ছেলেকে কাজে লাগিয়ে দিতে হবে।”

‘সরকারের’ মর্জির সামনে শিরদাঁড়া নুইয়ে স্কুলশিক্ষাকে ছুটিতে পাঠিয়েছে বিকাশ ভবন। তবু এই সমস্যাটা কর্তারা ভাবলেন না কেন?

এক কর্তার স্বীকারোক্তি— ‘‘সত্যি বলতে কী, এটা গোড়ায় কারও মাথাতেই আসেনি!’’ দফতর সূত্রের খবর, ছুটি শুরুর প্রায় মাসখানেক পরে ব্যাপারটা খেয়াল পড়ে। যদিও তা নিয়ে ‘উপরমহলে’ মুখ খোলার মতো বুকের পাটা কারও হয়নি।

‘ছুটির উত্সবে’ তৃণমূল-প্রভাবিত মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতিকে অবশ্য পাশে পেয়েছেন পার্থবাবু। সমিতির অনেকের যুক্তি, “পড়ুয়াদের সুস্থতা আগে দেখতে হবে। পরে ক্লাসে শিক্ষকেরা পুষিয়ে দেবেন।’’ ড্রপ আউটের সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই বলে ওঁদের দাবি। রাজ্যের প্রধান শিক্ষক সমিতি অবশ্য ভিন্নমত। সংগঠনের তরফে নীহারেন্দু চৌধুরীর আক্ষেপ— ‘‘মন্ত্রীর নির্দেশের অপেক্ষায় থেকে কত শত বাচ্চার মুখের ভাত যে শিক্ষা দফতর নষ্ট করল, তার ইয়ত্তা নেই।’’

এই ভুলের সংশোধন আদৌ সম্ভব কি না, তা নিয়েও ওঁরা ঘোর সন্দিহান।

প্রতিবেদক: মধুরিমা দত্ত, সুপ্রিয় তরফদার, বরুণ দে, সুস্মিত হালদার, নমিতেশ ঘোষ

Mid day meal Student School Vacation Teacher
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy