মর্জিনা বিবির হাতে সেরা সম্মান। —নিজস্ব চিত্র
‘সেরার সেরা’-র পুরস্কার হাতে নিয়ে তিনি বলছেন, কাজটা মোটেও সহজ ছিল না।
মর্জিনা বিবির জীবন-কাহিনির দিকে তাকালে বোঝা যাবে, কাজটা কেন সহজ ছিল না। কতটাই বা কঠিন ছিল সেরা হওয়ার সেই পথ।
পনেরো হতে না হতেই বিয়ে। তার পরেই তিন সন্তান। মাত্র কুড়িতেই বিধবা। পরের দয়ায় পেট চালাতে চালাতে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা ধরে গিয়েছিল তাঁর। এক শিক্ষকের পরামর্শে নাম লেখান স্বনির্ভর দলে। সেটা ২০০৬। ধীরে ধীরে মহাসঙ্ঘের অধিকর্তা পদে উত্তরণ। দশ বছর পরে সেই মর্জিনার নেতৃত্বেই দেশের সেরা মহাসঙ্ঘের পুরস্কার ছিনিয়ে নিল বীরভূমের ‘আত্মসম্মান সঙ্ঘ’।
ঘটনাও। আত্মসম্মান কাকে বলে, সঙ্ঘের অধীনে থাকা দুশোরও বেশি স্বনির্ভর দলের মহিলাদের তা নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে হাতে ধরে বুঝিয়েছেন দুবরাজপুরের সাহাপুর গ্রামের মর্জিনা। ২৩ ডিসেম্বর নয়াদিল্লিতে গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের ‘জাতীয় গ্রামীণ জীবিকা মিশনে’র অনুষ্ঠানে দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর হাত থেকে মর্জিনা বিবি এবং সঙ্ঘের সম্পাদিকা কুলসুম বিবি পুরস্কার নিয়ে এসেছেন। দেশের সমস্ত মহাসঙ্ঘের মধ্যে বাছাই করা ১০টি মহাসঙ্ঘকে পুরস্কৃত করেছে মন্ত্রক। কিন্তু, সেরার সেরা ‘আত্মসম্মান’।
এলাকার ৮-১০টি স্বনির্ভর গোষ্ঠী নিয়ে তৈরি হয় উপসঙ্ঘ। এমন ১০-১২টি উপসঙ্ঘ নিয়ে তৈরি হয় মহাসঙ্ঘ। সেই মহাসঙ্ঘের মাধ্যমেই পরিচালিত হয় স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ড। দেশজুড়ে থাকা লক্ষাধিক মহাসঙ্ঘের মধ্যে সঞ্চয়, ঋণ প্রদান ও শোধের হাল, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি-সহ নানা কাজের খতিয়ানের নিরিখে সেরা হয়েছে ‘আত্মসম্মান’। দুবরাজপুর ব্লকের মহিলা উন্নয়ন আধিকারিক মিতালি দাসরায়, মিশনের ব্লক প্রকল্প আধিকারিক সোমেন দত্ত জানালেন, শুধু নির্মল বাংলা মিশনেই ৭০ লক্ষ টাকার শৌচাগার গড়েছে ওই মহাসঙ্ঘ। এ ছাড়া সামাজিক বনসৃজন থেকে বিভিন্ন সচেতনতা মূলক প্রচারেও এগিয়ে ওই সঙ্ঘ। দুবরাজপুরের বিডিও বনমালী রায়, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি তনুশ্রী ঘোষরা মানছেন, কেন্দ্রীয় সরকার যে যে মানদণ্ডে সঙ্ঘের কাজ যাচাই করেছে, তার সব ক’টিতেই এগিয়ে ছিল আত্মসম্মান। এর নেপথ্যে রয়েছেন মর্জিনা এবং তাঁর হার না মানা লড়াই।
কেমন ছিল সে লড়াই?
মর্জিনা জানাচ্ছেন, স্বামীর মৃত্যুর পরে তিন সন্তান নিয়ে পথে বসেছিলেন। পাড়াপড়শির দানে পেট চলত। ভেবেছিলেন, স্কুলে মিড-ডে মিল রান্না করে সন্তানদের মুখে যদি দু’মুঠো খাবার দেওয়া যায়। স্বনির্ভর দলে যোগ দেওয়ার পরে জীবন বদলাতে থাকে। মর্জিনার কথায়, ‘‘প্রত্যন্ত গ্রামের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিধবা হয়ে সেই সময়ে দল করার কাজটা সহজ ছিল না। পথে বেরোলে জুটেছে নানা বিদ্রুপ।’’ কিন্তু, দমেননি। শিখেছেন নাবার্ড আয়োজিত কাঁথাস্টিচের কাজ। পরে সেই কাজই তিনি দলের অন্য মহিলাদের শেখান। আরও স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়তে উদ্বুদ্ধ করেন। ধাপে ধাপে মহাসঙ্ঘের সম্পাদিকা, বর্তমানে অধিকর্তা (ডিরেক্টর)। এখন তাঁর মহাসঙ্ঘের আওতায় ২২০টি স্বনির্ভর দল।
৩৫-এ পা দেওয়া মর্জিনার লড়াই থামেনি এখানেই। সমাজের বাঁকা চোখ উপেক্ষা করে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা যুবক জহিরউদ্দিন শেখকে বিয়ে করেছেন মর্জিনা। ক্লাস এইটে স্কুল ছাড়া মেয়ে এখন উচ্চ মাধ্যমিকের প্রস্তুতিতেও মগ্ন। মর্জিনা বলছেন, ‘‘সম্মান পেয়ে ভাল লাগছে। তবে, ব্লক প্রশাসন এবং আরও অনেকের সহযোগিতা না পেলে এখানে পৌঁছতে পারতাম না।’’ যাঁর পরামর্শে তাঁর জীবন বদলেছে, সেই সাহাপুর প্রাথমিক স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক শেখ সবের আলির কথায়, ‘‘মেয়েরাও যে চেষ্টা করলে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, সে কথাটাই ওকে ডেকে এক দিন বুঝিয়েছিলাম। আজ ওর জন্য গর্ব হচ্ছে। ওকে দেখে বাকিরাও শিখুক।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy