Advertisement
১৮ মে ২০২৪

প্রহরীর স্বাধীনতা দিবসে ছেলেবেলার গন্ধ

ও-পার থেকে আসা প্রশান্তির হাওয়া-বাতাস কাঁটাতারে ধাক্কা খেয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে তাঁর চোখ মুখ। চোখের সামনে পরিচিত দিগন্তবিস্তৃত সবুজ খেত। সীমান্তে তিনি ভিজছেন বৃষ্টিতে। কিন্তু ভাবুক হওয়ার অবকাশ নেই বছর তিপ্পান্নর উর্দিধারী মানুষটির।

সীমান্ত মৈত্র
বনগাঁ শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৬ ০৩:৫৭
Share: Save:

ও-পার থেকে আসা প্রশান্তির হাওয়া-বাতাস কাঁটাতারে ধাক্কা খেয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে তাঁর চোখ মুখ। চোখের সামনে পরিচিত দিগন্তবিস্তৃত সবুজ খেত। সীমান্তে তিনি ভিজছেন বৃষ্টিতে। কিন্তু ভাবুক হওয়ার অবকাশ নেই বছর তিপ্পান্নর উর্দিধারী মানুষটির।

কাঁটাতারের পাশে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিলেন তিনি। হাতে ইনসাস রাইফেল। চোখা দৃষ্টি। সীমান্তে অপরিচিত মুখ দেখলেই যা আরও তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। শক্ত হয় চোয়ালের রেখা। সাহস করে এগিয়ে গিয়ে হিন্দিতে কথা শুরু করতেই তিনিও দু’টো উত্তর দেন রাষ্ট্রভাষায়। কিন্তু কথা একটু এগোতেই হঠাৎ হিন্দি থেকে ঝরঝরে বাংলা বলে ওঠেন বিকাশবাবু।

তাঁর আসল নাম ‘বিকাশবাবু’ নয় কিন্তু। তাঁর পেশার কারণেই নাম আর বর্তমান পোস্টিং-এর এলাকা গোপন রাখতে হল। তবে জায়গাটা উত্তর ২৪ পরগনায়। এবং বিকাশবাবুর আদি বাড়ি এই জেলাতেই। বৃদ্ধ বাবা, মা, স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে বসিরহাটে তাঁর ভরা সংসার। মেয়ে পড়ে ক্লাস টুয়েলভে। ছেলে কলেজে। ইচ্ছে করলে এখানে এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করে যেতে পারেন আপনজনেরা। ডিউটি আওয়ারের বাইরে মেয়ের সঙ্গে ফোনে কথাও হয়। বাবার কাছে ‘বর্ডারের গল্প’ শুনতে চায় সে। কিন্তু ছুটি না পেলে বিকাশবাবুর নিজের বাড়ি ফেরার উপায় নেই।

তেপান্তরের মাঠের হাওয়া মন কেমন করে দিয়ে যায় প্রহরীর। বৃষ্টি ধরেছে তখন। বাংলাদেশের আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। কাঁটাতারের ওপারে পাটখেত। পায়ের কাছে গো-শালিক মাটি থেকে কেঁচো ধরে খাচ্ছে। কত দিন এ রাজ্যের প্রকৃতি ফুল-ফল-পাখি-মানুষ সে ভাবে দেখেননি। তাই কর্মজীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে নিজের রাজ্যে ফিরতে পেরে ভাল লাগছে, বলছিলেন বিকাশবাবু। বলছিলেন, ‘‘কিছু দিন পরেই দুর্গাপুজো। এমন কত পুজো তো পাহারা দিতে দিতেই কেটে গেল।’’

আর ১৫ অগস্ট?

‘‘তা-ও দেখলাম অনেক। কত সীমান্তে ঘুরলাম। পঞ্জাব, গুজরাত, রাজস্থান, জম্মু-কাশ্মীর। ওখানে ক্যাম্পে জাতীয় পতাকা তোলা হতো। পতাকার তলায় আমরা শপথ নিতাম, ‘আরও সতর্ক প্রহরী যেন হতে পারি। দেশের কাজে যেন ভুল না হয়।’ কিন্তু এ বারের ১৫ অগস্টটা কোথাও যেন আলাদা।’’— বলে একটু থামেন বিকাশবাবু।

কোথায় আলাদা?

‘‘বাংলার মাটিতে স্বাধীনতা দিবস দেখব কত দিন পর! এখানেও ক্যাম্পে পতাকা উঠবে। শপথ নেওয়া হবে। আর বাংলার হাওয়ায় আমি খুঁজব আমার ছেলেবেলা। স্কুলে-পাড়ায় পতাকা তোলা, মুঠোভরা লজেন্স-বিস্কুট, একসঙ্গে কেমন চিৎকার করে বলতাম, ‘জয় হিন্দ্!’ এখনও বলি অবশ্য’’— প্রহরী এ বার যেন বিব্রত হয়েই একটু হেসে ফেলেন। আবার চোখ চলে যায় কাঁটাতারের ও-পারে। রাইফেলটা কাঁধ বদল করে বলতে থাকেন, ‘‘বসিরহাটে থাকতেও বর্ডারে চলে যেতাম ছুটে। দেখতাম জওয়ানরা সীমান্ত পাহারা দিচ্ছেন। গা শিরশির করত। নিজেকে দেখতাম ওখানে। ওই রকম ইউনিফর্ম পরে, রাইফেল হাতে হেঁটে যাচ্ছি। দেশের কাজ করছি। আর মজা কী জানেন, একুশ বছর হতে না হতেই চাকরিটা পেয়েও গেলাম।’’

সে প্রায় তেত্রিশ বছর আগের কথা। প্রশিক্ষণ শেষে কিছু দিনের জন্য মালদায় পোস্টিং। তার পর ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নানা রাজ্যের পাক-সীমান্তে। বাংলা খবরের কাগজ পড়া হয় না বহু কাল। এমনকী এখানকার ক্যাম্পেও হিন্দি কাগজই আসে। মাঝেমধ্যে বাংলা খবরের চ্যানেলটা অবশ্য দেখা হয়। কিন্তু সব চেয়ে ভাল লাগে যখন কাঁটাতার-ঘেরা রাস্তায় মানুষগুলোর সঙ্গে দেখা হয়। বিকাশবাবু বলেন, ‘‘মনে হয় যেন, এঁরা বহু দিনের চেনা। কেউ খেতে কাজ করছেন, কেউ বাজারে যাচ্ছেন থলি হাতে। ভাল লাগে। বাঙালি জওয়ানের সঙ্গে কথা বলে ওঁদেরও স্বচ্ছন্দ লাগে। আমিও স্বস্তি পাই। অবশ্য আরও একটা স্বস্তি আছে এখানে...।’’

সেটা কী?

বিকাশবাবু বলেন, ‘‘মশাই, আমাদের রাজ্যের বর্ডারে তো চোরাচালান ছাড়া তেমন কোনও চিন্তা নেই। তা-ও আবার যেখানে কাঁটাতার আছে, সেখানে পাচারের সমস্যাও নেই। দু’দেশের জওয়ানদের যৌথ টহল রয়েছে। বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) অনেক সহযোগিতা করে।’’ ঠিক। কাশ্মীর বা পঞ্জাব সীমান্তে তো সারাক্ষণই ‘হাই অ্যালার্ট’। যে কোনও মুহূর্তে ধেয়ে আসতে পারে গোলাগুলি। বিকাশবাবু নিজেই জঙ্গিদের সঙ্গে লড়েছেন একাধিক বার। রুখে দিয়েছেন অনুপ্রবেশ।

‘‘১৫ অগস্টের আগে কেমন লাগছে জিজ্ঞেস করছিলেন না? আজ সত্যি কী মনে হচ্ছে জানেন? যত নষ্টের গোড়া ওই কাঁতাটার। দেশটা যদি ভাগ না হতো, তা হলে তো এখানে রাইফেল হাতে কারও দাঁড়ানোর দরকারই হতো না!’’

প্রহরী থামেন। সূর্য ডুবে গিয়েছে কখন। কাঁটাতার বেয়ে নেমে আসছে স্বাধীনতা দিবসের রাত!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sentinel Independence day
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE