E-Paper

যুদ্ধাকাশের নীচে খবরের কবিতা ফিরি গানওয়ালার

কাগজ কিনে প্রতিটি সংবাদে সুর ও ছন্দ বসিয়ে গ্রামীণ হাটে খবরের ‘আপডেট’ বিলিয়ে দিন যাপন নিঃসঙ্গ গানওয়ালা শেখ আরেজুল্লা হোসেনের। যিনি খবর সংগ্রাহক, ছড়াকার, প্রকাশক, গাইয়ে এবং নিজের ৫ টাকার প্যামফ্লেটের হকার।

রাহুল রায়

শেষ আপডেট: ১০ মে ২০২৫ ০৮:৫৮
শেখ আরেজুল্লা।

শেখ আরেজুল্লা। —ফাইল চিত্র।

ধোপদুরস্তের ধারে কাছে নয়, বরং বলা ভাল তাঁর একদা সাদা পাঞ্জাবির হাতায় মুখ লুকিয়ে আছে পুরনো দৈন্য। গলার শিরায় স্পষ্ট ধরা পড়ছে কষ্ট। হাতে আধ-ভাঁজ করা একটি বাংলা দৈনিক।

হাটের পাঁচমিশেলি হট্টগোল আর ভ্যাপসা গরম উজিয়ে, ভিড় জমানো জনা বিশেক হাটুরের সামনে গলার স্বর আপ্রাণ তুলে আওড়ে চলেছেন তিনি, ‘শুনুন গো শুনুন হাটুরে বাবুরা...’— হাতের সেকেলে মাউথপিস নানাবিধ যান্ত্রিক শব্দ করে ব্যাগড়া দিলেও অন্য হাতের মরচে পড়া ঘুঙুর গ্রামীণ ছড়ার সঙ্গে দিব্যি তাল মিলিয়ে চলেছে। তিনি গাইছেন— জনে জনে পর্যটকে (পর্যটককে)/ খুন করল ওরা/ তোদের না আছে জাত না ধর্ম,/ মানুষ
নাকি তোরা!

হালফিলে আন্তর্জালের অনুপ্রবেশে বেশ খানিকটা পিছিয়ে পড়েছেন তিনি। সে সব নেটিজেনদের তেমন রেয়াত অবশ্য তিনি করেন না। বুক বেঁধে রয়েছেন নিত্যকার বাংলা দৈনিকে। তাঁর ঝাপসা চোখে গোটা দুনিয়ার আধ-খোলা জানালা এখনও ওটাই। কাগজ কিনে প্রতিটি সংবাদে সুর ও ছন্দ বসিয়ে গ্রামীণ হাটে খবরের ‘আপডেট’ বিলিয়ে দিন যাপন নিঃসঙ্গ গানওয়ালা শেখ আরেজুল্লা হোসেনের। যিনি খবর সংগ্রাহক, ছড়াকার, প্রকাশক, গাইয়ে এবং নিজের ৫ টাকার প্যামফ্লেটের হকার।

‘‘তবে আগের মতো আর কথায় কথায় ছড়া বাঁধতে পারি না’’, আফশোস করছেন আরেজুল্লা। বলছেন, ‘‘ওই যে করোনা বলে রোগটা এল, তার পর থেকে নিয়মিত আর বেরোতে পারি না। বিরাশি বছর বয়স হল!’’ তবু খবরের কাগজখানা হাতে পেলে গলায় যেন সুর রিনরিন করে ওঠে।

সাকিন জয়রামপুর, থানা হোগলবেড়িয়া। নিঃসঙ্গ আরেজুল্লাকে বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা নদিয়ার আপামর গ্রামীণ মানুষ অবশ্য চেনে ‘গানওয়ালা’ নামে। সাত সকালে পাঁচ টাকা খরচ করে খবরের কাগজ কেনেন আরেজুল্লা। তারপর খবরগুলো পড়ে ছড়া তৈরির পুরনো অভ্যাসে ডুব দেন। স্থানীয় পত্রিকার সম্পাদক দেবজ্যোতি কর্মকার বলেন, ‘‘মানুষটার পদ্ধতি সেকেলে হতে পারে কিন্তু তিনি আদ্যন্ত আপডেটেড।’’

আরেজুল্লার আবছা মনে আছে, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। ‘‘দলে দলে মানুষ সীমানা পেরিয়ে এ পারে চলে আসছে। কোলের বাচ্চাটার জন্য ভাতের ফ্যান চাইছে মা...!’’ মুক্তিযুদ্ধের আবহে পাঁচ দশক আগে আরেজুল্লা লিখেছিলেন—ভারতের সৈন্য গিয়ে করেছিল রণ/পরাজিত হয়েছিল শত্রু সৈন্যগণ.../বাঁচল প্রাণে মহান নেতা শেখ মুজিবর/বাংলাদেশে ফিরে এসে পেল বাড়িঘর,/ এ খবরও অনেক জনেই জানে, সেই নেতাকেও বাঙালিরা বাঁচতে
দেয়নি প্রাণে!

আরেজুল্লার কথায়, ‘‘সে এক সময় ছিল, গ্রামের পথে ঘিরে ধরে মানুষ জানতে চাইত, আজ কী খবর আছে, আমিই তখন গ্রামীণ মানুষের কাছে দুনিয়ার মুখ!’’ স্থানীয় ছাপাখানার অস্পষ্ট কালিতে ছাপা ছড়া (আরেজুল্লার ভাষায় গীতিকবিতা) বোঝাই পাঁজা পাঁজা লিফলেট সেই সব হারানো দিনের স্মৃতি পাঁজরে নিয়ে জমে আছে উঠোনের কোণায়।

তিন ছেলে পরিযায়ী শ্রমিক। সংসারে ফিকে স্বাচ্ছল্য আসার মুখেই থাবা বসিয়েছিল নোটবাতিলের ঘোষণা। আরেজুল্লা লিখলেন— ‘শতকরা বাহাত্তর জন দেশবাসী অর্থহীন/ কুড়ি টাকা রোজগার করবে প্রতিদিন/ জোটে না অন্ন জঠর কেঁদে মরে/ উনুনে জ্বলে না আগুন, বহু রান্না ঘরে।’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Rural Areas News Person Society

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy