Advertisement
E-Paper

নাকের বদলে নরুন, শিল্পের বদলে শর্টকাট রাস্তা পেয়েছে সিঙ্গুর

এক সময় ছিল আলপথ। এখন সেখানে শুকনো খড় জঙ্গলের বুক চিরে সাপের মতো শুয়ে রয়েছে একটা ধূসর রাস্তা। অ্যাসফাল্টের পরত বেশ কয়েক বছর আগে পড়েছিল। ক্ষইতে ক্ষইতে এখন রয়ে গিয়েছে তার এবড়োখেবড়ো স্মৃতি। তবে আলপথের চেয়ে তা আলবাত ভাল। বাইক ছুটছে হু হু করে। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে থেকে শর্টকাটে সিঙ্গুরের ভিতরে পৌঁছে যেতে এখন আর কোনও হাঙ্গামাই নেই।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০১৬ ০২:০৭
পাঁচিল ভেঙে খুঁজে নাওয়া শর্টকাট। সিঙ্গুরে টাটার প্রস্তাবিত কারখানা চত্বরের বুকে চিরে রোজকার অবৈধ যাতায়াত।— নিজস্ব চিত্র।

পাঁচিল ভেঙে খুঁজে নাওয়া শর্টকাট। সিঙ্গুরে টাটার প্রস্তাবিত কারখানা চত্বরের বুকে চিরে রোজকার অবৈধ যাতায়াত।— নিজস্ব চিত্র।

এক সময় ছিল আলপথ। এখন সেখানে শুকনো খড় জঙ্গলের বুক চিরে সাপের মতো শুয়ে রয়েছে একটা ধূসর রাস্তা। অ্যাসফাল্টের পরত বেশ কয়েক বছর আগে পড়েছিল। ক্ষইতে ক্ষইতে এখন রয়ে গিয়েছে তার এবড়োখেবড়ো স্মৃতি। তবে আলপথের চেয়ে তা আলবাত ভাল। বাইক ছুটছে হু হু করে। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে থেকে শর্টকাটে সিঙ্গুরের ভিতরে পৌঁছে যেতে এখন আর কোনও হাঙ্গামাই নেই।

টাটার কারখানা হোক বা না হোক, পাঁচিলটাকে ভেঙে দেওয়া গিয়েছে অজস্র জায়গায়। সেই ফাঁক দিয়েই প্রস্তাবিত কারখানা চত্বরে অবাধ প্রবেশ এখন। টাটা কর্তৃপক্ষ কারখানা চত্বরে যে সব রাস্তা বানিয়েছিল, তাতে বাইক ছুটিয়ে শর্টকাটে সোজা দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠা যায় এখন। কারখানার পাঁচিলের এক প্রান্ত হাইওয়ের একেবারে গায়ে। অন্য প্রান্ত সিঙ্গুর ব্লকের অন্দরমহলে। গ্রামের ভিতরে যার যেখানে সুবিধা হয়েছে, তিনি সেখানেই ভেঙে দিয়েছেন পাঁচিল। কম সময়ে হাইওয়ে পর্যন্ত পৌঁছনোর জন্য একাধিক রাস্তা পাওয়া গিয়েছে হাজার একরের বিশাল খণ্ডহরে। কারখানার জন্য জমি অধিগ্রহণ হওয়ার আগে তো সেখানে ছিল আলপথ। আর কোথাও কোথাও নিচু বা জলা জমি। সেখান দিয়ে বাইক বা সাইকেল নিয়ে যাতায়াত সম্ভব ছিল না। হেঁটে গেলেও সময় লাগত অনেক। কারখানা না-ই বা পাওয়া যাক, শর্টকাটে হাইওয়েতে ওঠার বন্দোবস্ত তো হয়েছে। পাঁচিল ভাঙতে প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ যে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে, তাঁদের বোলচাল এখন অনেকটা এ রকমই।

সিঙ্গুরের কারখানা চত্বর এখন লুঠপাটেরও স্বর্গরাজ্য। অস্থায়ী শেডের করোগেটেড শিট বা অ্যাজবেসটস কারা যেন খুলে নিয়ে গিয়েছে। লোহার কাঠামোগুলো কঙ্কালের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ধীরে ধীরে উধাও হচ্ছে। কোনও দিন নাটবল্টু হারিয়ে যাচ্ছে। কখনও লোহার বড় পাত গায়েব হচ্ছে। কখনও পড়ে থাকা যন্ত্রাংশের অংশবিশেষ খোওয়া যাচ্ছে।

আদালতের নির্দেশ, যত দিন না জমি মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে, তত দিন সিঙ্গুরে প্রস্তাবিত কারখানা চত্বরের সব রকম নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে রাজ্য সরকারকে। হুগলি জেলা প্রশাসন পুলিশ ক্যাম্প বসিয়েছে কারখানার পাঁচিলের ভিতর। কিন্তু পুলিশের চোখের সামনে দিয়েই কারখানা চত্বর হয়ে যাতায়াত চলে অবাধে। শেড, লোহা, যন্ত্রাংশ গায়েব হয়ে গেলেও পুলিশ কেন যেন টের পায় না। অজস্র জায়গায় পাঁচিল ভেঙে গিয়েছে বা এখনও যাচ্ছে। পুলিশ তাও দেখতে পায় না।

সিঙ্গুর শিল্প উন্নয়ন কমিটি নামে একটি সংগঠন মাথা তুলেছে বামেদের সমর্থনে। নেতৃত্বে সিঙ্গুরের প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক বিদ্যুৎকুমার দাসের পুত্র উদয়ন দাস। পেশায় চিকিৎসক উদয়ন নিজের নার্সিংহোমে বসে বললেন, ‘‘তৃণমূল নেতারা পাঁচিল ভাঙতে প্ররোচনা দিচ্ছেন। কিন্তু বুঝতে পারছেন না, সুদে আসলে সব ক্ষতিপূরণ আদায় করে নেবে টাটা। কোথায় কবে পাঁচিল ভাঙা হচ্ছে, কোন অংশ থেকে কী কী চুরি যাচ্ছে, সব রেকর্ড রাখছেন ওঁরা। আদালতে সে সব পৌঁছে যাবে। আর তাতে কী বিপুল অঙ্কের ক্ষতিপূরণ রাজ্য সরকারের কোষাগার থেকে যাবে, সিঙ্গুরের তৃণমূল নেতাদের সে ধারণা নেই।’’ উদয়নের কটাক্ষ, ‘‘প্রচুর আস্ফালন করে তো সিঙ্গুরের মানুষকে তৃণমূল উপহার দিল একটা ধ্বংসস্তূপ। তাই এখন পাঁচিল ভেঙে রাস্তা বার করছে। ভাবখানা এমন যে, কী রকম শর্টকাট খুঁজে দিলাম দেখ!’’

স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের অবশ্য দাবি, টাটার পাঁচিল কিছু কিছু জায়গায় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভেঙে পড়েছে। কেউ প্ররোচনা দিয়ে পাঁচিল ভাঙায়নি। আর চুরি প্রসঙ্গে তাঁদের দাবি, টাটা সব যন্ত্রাংশই তুলে নিয়ে গিয়েছে। চুরি হওয়ার মতো কিছুই নেই কারখানা চত্বরে।

তৃণমূল-সিপিএম চাপান-উতোর না থামলেও, সিঙ্গুরের শিল্প সম্ভাবনার চাকাটা যে থমকে গিয়েছে, তা কিন্তু আজ একান্তে স্বীকার করে নিচ্ছেন এলাকার ডান-বান সব শিবিরই। আর থমকে যাওয়ার আগে যেটুকু শিল্প পরিকাঠামো গড়ে উঠতে পেরেছিল সিঙ্গুরে, রোজ তা একটু একটু করে কমে যাচ্ছে। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে।

কে দায়ী? উত্তর মেলে না। শিল্পের বিশাল সমাধিক্ষেত্রে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনির মতো ফিরে আসে শুধু প্রশ্নটাই।

State Singur Industry Land Problem Short Cut Road Cut short distance Highway
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy