কোনও জমি বেসরকারি সংস্থার মালিকদের হাতে। তা নিয়ে তেমন সমস্যা নেই। কিন্তু বহু জমির মালিক আবার কৃষক। সেখানে নিয়মিত চাষও হয়। আর সেই কারণেই জমি হাতে পাওয়া অনিশ্চিত। ফলে কার্যত বিশ বাঁও জলে চলে গিয়েছে উদ্যোগের ভবিষ্যৎ।
উদ্যোগ, মানে নিউটাউনে নতুন রাস্তা গড়ার তোড়জোড়। উপনগরীর উপকণ্ঠে বেসরকারি সংস্থা ও কৃষকদের মালিকানাধীন জমির উপর দিয়ে নতুন রাস্তাটি বানানোর পরিকল্পনা করেছে হিডকো। টানা পথ নয়। বিস্তর শাখাপ্রশাখা বিশিষ্ট সড়ক-জাল (রোড নেটওয়ার্ক) যাকে বলে। সব মিলিয়ে যার দৈর্ঘ্য দাঁড়াবে ১৭ কিলোমিটার। কুড়ি মাস আগে এ ব্যাপারে বিজ্ঞপ্তি জারি হলেও উদ্যোগ এখনও আঁতুড়েই আটকে। উপরন্তু সিঙ্গুরে সাম্প্রতিক জমি ফেরত পর্বের পরে নিউটাউনের রাস্তা আদৌ দিনের আলো দেখবে কি না, সে ব্যাপারে হিডকো’র অন্দরেই ঘোরতর সংশয় দানা বেঁধেছে।
সংশয়ের সুর রাজ্য সরকারের কণ্ঠেও। নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম স্বয়ং প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে ধন্দে। তিনি জানিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট বেসরকারি সংস্থা ও চাষিদের থেকে বাজারদরে জমি কিনে সরকার রাস্তা বানাবে। কিন্তু কেউ জমি বেচতে রাজি না-হলে যে কিছু করার নেই, মন্ত্রী তা-ও জানিয়ে রাখছেন। ‘‘সে ক্ষেত্রে কাজ আটকে থাকবে। রাস্তা হবে না। আমরা জোর করে জমি নেব না।’’— সাফ কথা মন্ত্রীর।
তবে নগরোন্নয়মন্ত্রীর আশা, রাস্তার উপযোগিতা ভাল ভাবে বোঝালে চাষিরা বুঝবেন। জমিও দেবেন। ঘটনা হল, ‘বোঝানোর’ জন্য এত দিন চাষিদের দরজায় পৌঁছতেই পারেননি হিডকোর কর্তারা। আর এখন সিঙ্গুরের প্রেক্ষাপটে কর্তাদের অনেকেই কার্যত হাল ছেড়েছেন। কেন?
সরকারি মহলের একাংশের বক্তব্য: সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে সিঙ্গুরে টাটাদের গাড়ি কারখানার জন্য অধিগৃহীত জমি রাজ্য চাষিদের ফিরিয়ে দিচ্ছে। এতে উৎসাহিত হয়ে জেলায় জেলায় জমি ফেরানোর দাবি মাথাচাড়া দিচ্ছে। বর্ধমানে মিষ্টি হাব, শিলিগুড়ির কাওয়াখালিতে উপনগরী, বোলপুরে থিম শহর— বিভিন্ন প্রকল্পে জমিদাতাদের অনেকে জমি ফেরত চাইছেন। খাস নিউটাউনে চাষের জমি ফেরানোর দাবি ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। বিক্ষোভ ঠেকাতে আগাম ধরপাকড়ও শুরু করেছে পুলিশ।
এমতাবস্থায় নিউটাউনে রাস্তার জন্য চাষের জমি পাওয়া কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে বড় প্রশ্নচিহ্ন ঝুলছে সরকারি মহলেই। প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকাটি মূল নিউটাউনের ধার ঘেঁষে, যেখানে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার মোট ২৪টি মৌজা নিয়ে গড়া হয়েছে ‘নিউটাউন প্ল্যানিং এরিয়া।’ এখানকার জমিগুলো আগে ভাঙড়-রাজারহাট এরিয়া ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (ব্রা়ডা)-র অধীনে ছিল। ব্রাডা ভাঙার পরে হিডকো’র তত্ত্বাবধানে এসেছে। প্ল্যানিং এরিয়া’র জমি ব্যবহার সম্পর্কে ২০১৫-য় পরিকল্পনা ও মানচিত্র তৈরি করেছে হিডকো। পথ-প্রকল্পটি তারই অঙ্গ।
এবং এর মধ্যে পড়ছে প্রায় ১৫টি ছোট-বড় আবাসন প্রকল্পের জমি। বেশ কিছু নির্মাণসংস্থা সেখানে কাজ করছে। হিডকো তাদের জানিয়ে রেখেছে, জমি দিলে অনুমোদিত নক্শার বাইরেও বাড়তি নির্মাণের সুযোগ মিলবে।
সূত্রের খবর: হিডকোর প্রস্তাবে অধিকাংশ সংস্থা রাজি। কিন্তু সমস্যার কেন্দ্রে রায়গাছি, রেকজুয়ানি, পাথরঘাটা, খামার, বিষ্ণুপুর, ভাতেন্ডা-সহ বিভিন্ন মৌজায় ছড়িয়ে থাকা বিঘের পর বিঘে চাষের জমি।
যেগুলোর মালিকদের মধ্যে এখনও রাস্তা সম্পর্কে বিশেষ উৎসাহ নেই। এক নগরোন্নয়ন-কর্তার কথায়, ‘‘যেখানে সিঙ্গুর বা অন্যত্র সরকারের হাতে থাকা জমিই চাষিরা ফেরত চাইছেন, সেখানে নিউটাউনের ওই সব জমি তো রয়েছে চাষিদেরই হাতে! তাতে চাষও হয়। তা ওঁরা ছেড়ে দেবেন, এমনটা ভাবা বেশ কঠিন।’’
উপরন্তু বেসরকারি সংস্থার মতো ওঁদের কোনও বাড়তি লাভের সুযোগ থাকছে না। ‘‘হিডকো বোধহয় এ সব বুঝেই চাষিদের কাছে জমি চাইতে যেতে পারেনি।’’— পর্যবেক্ষণ কর্তাটির।
পরিকল্পনার গোড়ায় গলদ দেখছে নির্মাণ শিল্পমহলও। তাদের মতে, সরকারের জমি-নীতি মাথায় রেখে প্রথমেই এ সব অসুবিধের কথা ভাবা উচিত ছিল। নতুন রাস্তা তৈরির পরিবর্তে চালু রাস্তা সম্প্রসারণে নজর দিলেও লাভ হতো। সংস্থাগুলির আরও আশঙ্কা, চাষিরা জমি বাঁচাতে আন্দোলন শুরু করলে তার ঢেউ এসে আছড়ে পড়তে পারে তাদের প্রকল্পে। যেমন পড়েছে কাওয়াখালিতে।
এ হেন পরিস্থিতিতেও নগরোন্নয়নমন্ত্রী অবশ্য প্রকল্পকে এখনই বাতিলের খাতায় ফেলছেন না। ‘‘আগে নির্মাণ সংস্থার থেকে জমি নিয়ে কাজ শুরু হবে। পরে চাষিদের সঙ্গে আলোচনা করে জমি কিনবে সরকার।’’— বলছেন তিনি। যদিও হিডকো এখনও জানে না, সে কাজ আদৌ হবে কি না।
কিংবা হলে কবে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy