Advertisement
০২ মে ২০২৪
Justice Abhijit Gangopadhyay

মুড়ি-মুড়কির মতো দুর্নীতি হয়েছে: বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়

মূলত স্কুলে ‘বেআইনি’ শিক্ষক নিয়োগ মামলা ঘিরেই জনমানসে এখন পরিচিত নাম বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর নির্দেশে ইতিমধ্যেই চাকরি হারিয়েছেন বহু অযোগ্য প্রার্থী।

ভবিষ্যতেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি কঠোর পদক্ষেপ নেবেন বলে জানালেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।

ভবিষ্যতেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি কঠোর পদক্ষেপ নেবেন বলে জানালেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৭:৫৭
Share: Save:

রাজ্যে স্কুলে নিয়োগে ‘মুড়ি-মুড়কির’ মতো দুর্নীতি হয়েছে বলে মনে করেন কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। সোমবার এবিপি আনন্দ-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, মুড়ি-মুড়কির মতো দুর্নীতি হয়েছে বলেই মুড়ি-মুড়কির মতো সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিতে হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ভবিষ্যতেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁকে কঠোরতম, এমনকি অভাবিত পদক্ষেপ করতে হতে পারে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

কারণ হিসেবে বিচারপতি বলেছেন, ‘‘এত দুর্নীতি জীবনেও কল্পনা করতে পারি না’’। এই নিয়োগে স্কুল সার্ভিস কমিশন এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদ যে ভাবে কোর্টে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পেশ করেছিল, তা থেকেই যে দুর্নীতির বিষয়টি সামনে এসেছিল, তা-ও স্পষ্ট জানিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে জানিয়েছেন, তদন্তে সিবিআইয়ের ‘ঢিলেঢালা’ গতিতেও মাঝেমধ্যে বিরক্ত বোধ করেছেন তিনি। তবে তাঁর আশা, শেষ পর্যন্ত দোষীরা ধরা পড়বেন এবং সাজা পাবেন।

মূলত স্কুলে ‘বেআইনি’ শিক্ষক নিয়োগ মামলা ঘিরেই জনমানসে এখন পরিচিত নাম বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর নির্দেশে ইতিমধ্যেই চাকরি হারিয়েছেন বহু অযোগ্য প্রার্থী। বাদ পড়েননি মন্ত্রীর মেয়েও। এ দিনও তিনি বলেছেন, ‘‘যাঁরা জালিয়াতি করে চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকের চাকরি যাবে। ধরতে পারলেই চাকরি যাবে। তারা যেন নিশ্চিন্তে না থাকে।’’ ‘বেআইনি পথে’ নিযুক্তদের সম্পর্কে বিচারপতির মন্তব্য, ‘‘এঁরা কী শেখাবেন? এঁরা তো (বরং) স্কুলে টুকতে সাহায্য করবেন!’’

এ দেশে বিচারপতিরা সাধারণত সরাসরি সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেওয়া বা মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বিচারপতিরা কী করতে পারেন এবং কত দূর যেতে পারেন, তা ব্যাঙ্গালোর প্রিন্সিপল-এ স্পষ্ট করা আছে। বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে আমার সম্পূর্ণ আস্থা আছে। বিচারপতিরও বাক্‌স্বাধীনতা আছে।’’

প্রসঙ্গত এই সাক্ষাৎকারের সম্প্রচার বন্ধের আর্জি জানিয়ে এ দিনই কলকাতা হাই কোর্টে জনস্বার্থ মামলা হয়েছিল। কিন্তু প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তব এবং বিচারপতি রাজর্ষি ভরদ্বাজের ডিভিশন বেঞ্চ তা খারিজ করে দেয়। সেই মামলার ক্ষেত্রেও ডিভিশন বেঞ্চ ‘ব্যাঙ্গালোর প্রিন্সিপল অব জুডিশিয়াল কনডাক্ট’-এর কথা জানিয়েছে। ঘটনাচক্রে সম্প্রতি বিচার বিভাগকে প্রায়শই রাজনীতির আঙিনায় নিয়ে যান রাজনৈতিক নেতারা। এ দিন সাক্ষাৎকারে সেই প্রসঙ্গ উঠেছিল। বিশেষত বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে সম্প্রতি তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নানা মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এ দিন বিচারপতি নিজের কড়া মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। ভবিষ্যতে তাঁর সঙ্গে সম্পর্কিত কোনও বিষয়ে অবমাননাকর মন্তব্য শুনলে ‘কঠোরতম’ পদক্ষেপ করার হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন। আদালত অবমাননায় তিন মাসের কারাবাস হতে পারে জানিয়ে তাঁর মন্তব্য, ‘‘পরে হয়তো আমাকে মেরে ফেলতে পারেন। কিন্তু বিচার বিভাগের অবমাননা সহ্য করব না।’’

মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বিচারপতির একটি অনুষ্ঠানে সাক্ষাতের প্রসঙ্গও এ দিন উঠেছিল। মুখ্যমন্ত্রীর ব্যবহার তাঁর ‘অত্যন্ত ভদ্র’ মনে হয়েছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ‘আপনি নিজের কাজ করে যান’ বলেছিলেন বলে জানিয়েছেন। সেই মন্তব্যে বিচারপতি কোনও ‘ক্রূরতা’ খুঁজে পাননি।

সাক্ষাৎকারে এ দিন বারবার দুর্নীতির প্রসঙ্গই ঘুরেফিরে এসেছে। সেই প্রসঙ্গে বিচারপতি বলেছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধেই তাঁর আপোসহীন লড়াই। এই দুর্নীতির লড়াইয়ে তাঁর অবস্থানের জন্য তাঁকে বিচার বিভাগ থেকে বহিষ্কার করা হলেও তিনি পিছপা হবেন না। যেমন, তিনি মনে করেন, এজলাসে বসে তাঁর নানা পর্যবেক্ষণ এবং মন্তব্য তাঁর নিজের ‘শক্তি’। এজলাসে বসে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সারমেয়র ফ্ল্যাট নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন। এ দিন সেই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘ওঁর ঘনিষ্ঠ এক প্রোমোটারের ফ্ল্যাটে কুকুর থাকত। নাকতলায় আমার বন্ধুরা আছে। তাঁদের কাছ থেকেই জেনে বলেছিলাম।’’

বিচারপতি-জীবন শেষে রাজনীতিতে যুক্ত হবেন কি না, সেই প্রশ্নে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় ‘এখনও কোনও’ সিদ্ধান্ত নেননি। তাঁর মন্তব্য, ‘‘রাজনীতি সব সময় দলীয় রাজনীতি হবে এমন কোনও কথা নেই। পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে রাজনীতির কথাও তো বলা যেতে পারে।’’ এ দিন দেশে প্রকৃত শাসন, গণতন্ত্রের বিকাশ, দলত্যাগ বিরোধীআইন ইত্যাদি সম্পর্কে নিজস্ব মতামত দিয়েছেন। বলেছেন, ‘‘সন্ত্রাস মাঝেমধ্যে ভাল কাজ দেয়। তবে সেই সন্ত্রাস হিংসাশ্রয়ী নয়। আইনের কড়া প্রয়োগে দুর্নীতিগ্রস্তদের সন্ত্রস্ত করাই এ ক্ষেত্রে বলতে চেয়েছি।’’

ক্যানসার আক্রান্ত চাকরিপ্রার্থী সোমা দাসকে নিয়োগ যাতে করা যায়, তা সরকারকে সহমর্মিতার সঙ্গে বিবেচনা করতে বলেছিলেন বিচারপতি। সোমা চাকরি পেয়েছেন। সেই প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য, ‘‘আমি তো সরাসরি কোনও নির্দেশ দিইনি। তবুও মুখ্যমন্ত্রী, শিক্ষা দফতর সোমাকে নিয়োগ করায় আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি। আমি তো রুপোর চামচ মুখে নিয়ে জন্মাইনি। বেকারত্বের কষ্ট বুঝি।’’ তবে এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকার পাওনাগন্ডা সরকারি অফিসারেরা না-মেটানোয় রীতিমতো খড়্গহস্ত হন বিচারপতি। তাঁর কড়া নির্দেশ পেয়েই শিক্ষা দফতর বৃদ্ধার পাওনাগন্ডা মেটায়।

অনেক ক্ষেত্রেই এজলাসে তাঁর মধ্যে আবেগের বহিঃপ্রকাশ ধরা পড়ে। এ প্রসঙ্গে বিচারপতি বলেন, মানুষ হিসেবে মানুষের দুর্দশায় তাঁর আবেগ ফুটে ওঠে। কিন্তু বিচার শেষে রায়দানের ক্ষেত্রে আবেগ নয়, তথ্য এবং যুক্তিকেই তিনি প্রাধান্য দেন।

এ সবের পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনের খণ্ডচিত্রও সাক্ষাৎকারে ধরা পড়েছে। যেমন বলেছেন দেশে নাগরিক, মামলা ইত্যাদির অনুপাতে বিচারক এবং বিচারপতির অপ্রতুলতার কথা। বিচারপ্রার্থী এবং বিচারপ্রাপ্ত নাগরিকের ফারাক যে আছে, তা-ও মেনে নিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘‘ফারাক থাকছে বলেই মানুষ কোর্টে না-এসে পার্টি অফিসে যান।’’ নিম্ন আদালতের পরিকাঠামোর অভাবও চেপে রাখেননি বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। জানিয়েছেন, কলকাতা হাই কোর্টের ‘জ়োনাল জজ’ হিসেবে পরিকাঠামোর অভাব দেখেছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE