Advertisement
E-Paper

জমানার রং-বেরং

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর পাশ করে ১৯৭৩ সালে নিউ ইয়র্কের সেন্ট জনস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন তিনি। ’৭৭-এ ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি’ থেকে ‘ইয়ং সায়েন্টিস্ট’ হিসেবে পদক পান।

শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০১:৪০
উৎসবের মেজাজ। খবর আসতেই আবির খেলায় মেতেছেন কর্মী-অধ্যাপকদের একাংশ। সোমবার বিশ্বভারতী চত্বরে ছবিটি তুলেছেন বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।

উৎসবের মেজাজ। খবর আসতেই আবির খেলায় মেতেছেন কর্মী-অধ্যাপকদের একাংশ। সোমবার বিশ্বভারতী চত্বরে ছবিটি তুলেছেন বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।

ছাত্র-শিক্ষাবিদ

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর পাশ করে ১৯৭৩ সালে নিউ ইয়র্কের সেন্ট জনস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন তিনি। ’৭৭-এ ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি’ থেকে ‘ইয়ং সায়েন্টিস্ট’ হিসেবে পদক পান। পেয়েছেন রাজা রমন, মেঘনাদ সাহা মেমোরিয়াল পদকের মতো সম্মান। প্রেসিডেন্সি কলেজ ও দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা ছাড়াও বিদেশের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কলাপক্কম পরমাণু কেন্দ্রে কাজ করা ছাড়াও কলকাতায় ‘এস এন বোস ন্যাশনাল সেন্টার ফর বেসিক সায়েন্স’-এর অধিকর্তা ছিলেন। সেখান থেকে নদিয়ার মোহনপুরে ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ’ (আইআইএসইআর)-এর অধিকর্তা। রজতকান্ত রায় অবসর গ্রহণের পর দায়িত্ব নেন সুশান্তবাবু। সে সময় রজতকান্তবাবু বলেছিলেন, “সুশান্তবাবু বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ। যে সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তা যোগ্য ব্যক্তির হাতেই যাচ্ছে।”

বিবাদ-বিভ্রাট

উপাচার্য পদে দায়িত্ব নেওয়ার পরই সুশান্তবাবু বন্ধ করে দেন বিশ্বভারতীর প্রাক্তনীদের সংগঠনের দফতর। সেই সঙ্গে বিশ্বভারতী এলাকায় ‘অ্যালামনি অ্যাসোসিয়েশন’-এর ‘প্রাক্তন’ সম্পাদক পুলক চক্রবর্তীর প্রবেশও নিষিদ্ধ করে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। একই নির্দেশ পেয়েছিলেন রবীন্দ্রভবনের ‘সাময়িক ভাবে বরখাস্ত’ হওয়া প্রাধিকারিক নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ও। এরপর থেকেই শান্তিনিকেতনে ক্ষোভ বাড়তে থাকে সুশান্তবাবুকে ঘিরে। অভিযোগ ওঠে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মের বাইরে গিয়ে তিনি ‘কন্ট্রোলার অব এগজামিনেশন’ পদ সৃষ্টি করেছেন। সে জন্য তিনি ইউজিসি (বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন) বা মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রকের অনুমতি নেননি। একে একে আর্থিক অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহার করে পদ সৃষ্টি, যৌন হেনস্থার ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার মতো বিভিন্ন অভিযোগে জড়ায় উপাচার্যের নাম। প্রাক্তনীদের সঙ্গে সঙ্গে কর্মী ও অধ্যাপকদের একাংশের সঙ্গেও তাঁর দূরত্ব বাড়ে কয়েকটি পদে নিয়োগে এবং পাঠভবন ও শিক্ষাসত্রের অধ্যক্ষদের বিনয় ভবনে বদলি করায়। অভিযোগ ওঠে, নিয়ম ভেঙে তিনটি ‘প্রোভস্ট’ পদে নিয়োগ নিয়েও। এ সবের প্রেক্ষিতেই গত অগস্ট মাসে বিশদ রিপোর্ট চেয়ে পাঠায় ইউজিসি। ঘটনাচক্রে অগস্ট মাসের শেষেই সিকিম থেকে বিশ্বভারতীতে পড়তে আসা প্রথম বর্ষের এক ছাত্রী যৌন হেনস্থার শিকার হন। অভিযোগ ওঠে, বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে মিটমাট করে নেওয়ার জন্য সওয়াল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। শেষ পর্যন্ত পড়া ছেড়ে সিকিমে ফিরে যেতে বাধ্য হন ওই ছাত্রী। বিষয়টি নিয়ে জলঘোলা শুরু হওয়ায় মন্ত্রকের নির্দেশে একটি তথ্য অনুসন্ধানী দলকে বিশ্বভারতীতে পাঠিয়েছিল ইউজিসি। প্রশ্ন ওঠে আগের চাকরির পেনশন পাওয়ার সঙ্গে উপাচার্য হিসেবে সুশান্তবাবুর বেতন নেওয়া নিয়েও।

বারবার অস্বস্তি

সুশান্ত-জমানায় একাধিক অস্বস্তিকর ঘটনা ঘটেছে বিশ্বভারতীতে। পাঠভবনের চতুর্থ শ্রেণির আবাসিক ছাত্রীকে প্রস্রাব খাওয়ানোয় অভিযুক্ত হস্টেল ওয়ার্ডেনকে ‘ক্লিন চিট’ দেওয়া, কৃষিবিদ্যা বিভাগে গাইডের বিরুদ্ধে ভিন্-রাজ্যের এক গবেষিকা শারীরিক হেনস্থার অভিযোগ তোলায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ওই গবেষিকাকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠা, বিশ্বভারতীর এক গবেষকের বিরুদ্ধে ভিন্‌-দেশের এক আবাসিক ছাত্রীকে যৌন হেনস্থার অভিযোগ ওঠা, কলাভবনে ভিন্‌-রাজ্যের এক প্রথম বর্ষের ছাত্রীর তিন সিনিয়ারের বিরুদ্ধে হেনস্থার অভিযোগ তোলা— দীর্ঘ তালিকা। সুশান্তবাবুর সময় একাধিক আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে পথে নামা পড়ুয়াদের সাসপেন্ড হওয়াও ‘অবাঞ্ছিত’ কারণে বারবার বার শিরোনামে এনেছে বিশ্বভারতীকে।

তবুও সুশান্ত

বিশ্ববিভারতীতে বিরোধীরাও কিন্তু মানছেন সুশান্তবাবুর সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হয়েছে রবীন্দ্রসঙ্গীত গবেষণাকেন্দ্র, ইন্টিগ্রেটেড সায়েন্স বিভাগ, বিশ্বভারতী স্পোর্টস বোর্ড। বাংলাদেশ ভবনের কাজকর্ম নিয়ে আলোচনা এগিয়েছে অনেকখানি। শ্রীনিকেতনেকে বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়ে সপ্তাহে একাধিক দিন সেখানে দফতরের কাজকর্ম শুরু হয়েছে। শ্রীনিকেতনে বিশ্বভারতীর আলাদা একটি ক্যাম্পাস করার পরিকল্পনাও করা হয়। তাঁর সময়েই বিশ্বভারতীর বিভিন্ন অতিথি নিবাসগুলিকে ঢেলে সাজা হয়। ছাত্র ও ছাত্রীনিবাসগুলিতেও চোখে পড়ার মতো সংস্কার হয়েছে। প্রশাসনিক ভবনকে কেন্দ্রীয় ভাবে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে। প্রশাসনিক কাজকর্মে গতি আনতে তাঁর সময়েই ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ শুরু। কর্ম দিবস বাড়ানোর উদ্দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে দৈনিক কাজের সময়সূচির পরিবর্তনও তাঁর আমলে।

দোলের আগে

উপাচার্যের বরখাস্ত হওয়ার খবর নিয়ে এ দিন শান্তিনিকেতন ছিল সরগরম। পানের গুমটি থেকে শুরু করে রাস্তার ধারের চায়ের দোকান— দিনভর আলোচনা হয়েছে। পড়ুয়া, শিক্ষক-অধ্যাপক, কর্মীরা তো বটেই, রিক্সা চালক, টোটো চালক এবং পর্যটকদের মধ্যেও চর্চা ছিল তুঙ্গে। আলোচনার বিষয়—সুশান্ত বরখাস্ত হলেন কি না! ক্রমশ বিভিন্ন সূত্রে বরখাস্তের খবর মিলতে বেড়েছে উচ্ছ্বাস। ফেসবুক, টুইটারে চলেছে চর্চা। দফায় দফায় নিজেদের মধ্যে এবং একাধিক মহলের সঙ্গে আলোচনা করেছে আন্দোলনকারী জয়েন্ট অ্যাকশান কমিটি।

ঘড়ির কাঁটা যখন একটা ছুঁইছুঁই, বিশ্বভারতীর বিভিন্ন কর্মী-অধ্যাপকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সুশান্তবাবুকে বরখাস্ত করা নিয়ে মন্ত্রকের চিঠিতে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সবুজ সংকেত দেওয়ার খবর। খবর যত ছড়ায়, ভিড় জমতে থাকে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে। নিশ্চিত হওয়ার পরে লাল-হলুদ-নীল আবিরে কার্যত অকাল হোলিতে মাতে বিশ্বভারতী। কোনও বঞ্চনা, শোক বা প্রতিবাদে মোমবাতি-মিছিল দেখতে অভ্যস্ত বিশ্বভারতী আনন্দের মিছিল দেখেছে এ দিন সন্ধ্যায়। গোটা আশ্রম এলাকা ঘোরার পরে উচ্ছ্বসিতেরা বিশ্বভারতীর মানোন্নয়ন ও গৌরব ফেরানো প্রসঙ্গে বক্তব্য রাখেন।

ছন্দপতন

মাতামাতির মধ্যে ভিড় ঠেলে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দিয়ে গাড়ি নিয়ে ফিরছিলেন সুশান্তবাবু ঘনিষ্ঠ অধ্যাপকদের সংগঠন ‘ইউনিভার্সিটি ফ্যাকাল্টি অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক পদার্থবিদ্যা অধ্যাপক বিকাশ গুপ্ত। অভিযোগ, ভিড়ের মধ্যে তাঁর গাড়ি আটকে যেতে জানলার কাচ নামাতেই কে বা কারা তাঁর নাকে ঘুষি মারে। নাক থেকে রক্ত ঝরতে থাকে বিকাশবাবুর। কোনও মতে সেখান থেকে বেরিয়ে তিনি পিয়ারসন হাসপাতালে যান। পরে বোলপুর থানাতে তিনি একটি অভিযোগও করেন। পুলিশ তদন্ত করছে। তবে বিকাশবাবু বলেন, “উপাচার্য বরখাস্ত হওয়া খবরে আমরা আনন্দিতও নই, আবার দুঃখিতও নই। উপাচার্য আসবেন, যাবেন।’’

ওঁরা বলেন

জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটির পক্ষে কিশোর ভট্টাচার্য, দেবব্রত হাজারি, প্রশান্ত মেসরম ও আনন্দদুলাল মিত্রদের প্রতিক্রিয়া, ‘‘বিশ্বভারতীকে কালিমালিপ্ত করা থেকে উদ্ধার করা এবং নানা দুর্নীতি থেকে রক্ষা করার প্রথম পদক্ষেপ সার্থক হয়েছে।’’ বিজেপি প্রভাবিত শৈক্ষিক সংঘের আহ্বায়ক অধ্যাপক বিল্পব লোহ চৌধুরী বলেন, “এই প্রথম দেশের কোনও ঐতিহ্যবাহী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে দুর্নীতি-সহ একাধিক অভিযোগে বরখাস্ত করা হল। বিশ্বভারতীর আধিকারিক, অধ্যাপক, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীদের একাংশ সচেতন থাকার জন্য এটা সম্ভব হয়েছে।’’ কর্মসমিতিতে রাষ্ট্রপতি তথা পরিদর্শকের প্রতিনিধি তথা কংগ্রেস নেতা সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “কোনও প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নেওয়ার পরে কেউ যদি মনে করেন সেই প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন, তা হলে বিশ্বভারতীর উপাচার্য সুশান্ত দত্তগুপ্তর যা দশা, তা-ই হবে।” এক সময় বিশ্বভারতীর শিক্ষক, বোলপুরের তৃণমূল সাংসদ অনুপম হাজরা বলেন, ‘‘শিক্ষা জগতে বিরল নজির। এমনকী, কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসেও।’’

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য

বিশ্বভারতীর সহ-উপাচার্য অধ্যাপক স্বপন দত্ত বলেন, ‘‘উপাচার্য সুশান্ত দত্তগুপ্তকে বরখাস্ত করার বিষয় নিয়ে কোনও চিঠি বা নির্দেশ আমরা পাইনি।’’

(তথ্য: মহেন্দ্র জেনা ও আবীর মুখোপাধ্যায়)

Professors VC viswabharati
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy