E-Paper

‘বাবা, কেন এমন হল’

শনিবার রাত ৮টা নাগাদ বেসরকারি হাসপাতাল থেকে ছাড়া হয় প্রণয়কে। তাঁকে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ছিলেন তাঁর আত্মীয়রা। তবে তাঁরা কোনও কথা বলতে চাননি।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৬:৪৪

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

‘আমরা তো বাবা সুখী পরিবার ছিলাম। কোনও অসুবিধা তো আমাদের ছিল না। বাবা, তা হলে কেন এমন হল?’ মঙ্গলবার মা-সহ তিন জনের মৃত্যুর কথা জানতে পেরে প্রণয় দে-কে প্রথম এই প্রশ্নই করেছিল তাঁর কিশোর ছেলে। এর পরে ছেলেকে ব্যবসার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই বলে জানিয়েছিলেন প্রণয়। ‘মা-সহ বাকিরা ওপরে গিয়েছে, আমরাও ওপরে গিয়ে আবার আগের মতো একসঙ্গে ভাল থাকব’—এ কথা বলে ছেলেকে মৃত্যুর পথ বেছে নিতে রাজি করিয়েছিলেন প্রণয়। ই এম বাইপাসের হাসপাতালে গিয়ে প্রণয় এবং তাঁর কিশোর ছেলের সঙ্গে শনিবার কথা বলে এ কথা জানা গিয়েছে, দাবি পুলিশের। আলাদা আলাদা ভাবে কথা বলা হলেও পিতা-পুত্রের এই বয়ান মিলে গিয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে।

শনিবার রাত ৮টা নাগাদ বেসরকারি হাসপাতাল থেকে ছাড়া হয় প্রণয়কে। তাঁকে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ছিলেন তাঁর আত্মীয়রা। তবে তাঁরা কোনও কথা বলতে চাননি। ট্যাংরার দে পরিবারের অন্য দুই সদস্য প্রসূন এবং তাঁর নাবালক ভাইপো ওই বেসরকারি হাসপাতালেই ভর্তি।

এ দিকে পুলিশি প্রশ্নের মুখে ওই নাবালক জানিয়েছে, কাকাকে ছুরি দিয়ে নিজের হাত কাটার চেষ্টা করতে দেখেছিল সে। তার সঙ্গে কথা বলে পুলিশ মনে করছে, গোটা পরিবারের আত্মহত্যার ‘পরিকল্পনা’র কথা সন্তানদের জানতে দেননি দুই ভাই। পায়েসের সঙ্গে ঘুম এবং উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ মিশিয়ে ‘খুনের’ পরিকল্পনা করেছিলেন। পরিকল্পনামাফিক সোমবার রাতে তা খাওয়ানো হলেও কিশোরের ঘুম ভেঙে যাওয়ায় অন্য ‘পথ’ বেছে নিতে হয় বলে ভাই-দের দাবি। মঙ্গলবার বেলার দিকে ঘুম ভেঙে মায়ের ঘরে গিয়ে তাঁকে কম্বল গায়ে শুয়ে থাকতে দেখেছিল বলে পুলিশের কাছে দাবি করেছে কিশোর। এর পরেই বাবাকে গিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করে সে।

পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ছেলেকে রাজি করিয়ে প্রথমে ঘরের ভিতরে বাকি তিন জন গলায় ফাঁস লাগিয়ে সবাই আত্মহত্যা করবেন বলে ঠিক করেছিলেন। কিন্তু বাবার কাছে এই কথা শুনে ভয় পেয়ে গিয়েছিল প্রণয়ের পুত্র। তাই গাড়ি নিয়ে রাতে বেরোনোর পরিকল্পনা করেন দুই ভাই। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, দুপুরের পর থেকে ঘর অন্ধকার করে ট্যাংরার চিত্ত নিবাসেই ছিলেন প্রণয়, তাঁর ছেলে এবং প্রসূন। বাড়ির ফ্রিজে থাকা সন্দেশ খেয়েছিলেন। ইতিমধ্যেই ওই বাড়ির ফ্রিজ থেকে অবশিষ্ট সন্দেশ এবং তিনটি প্লেট বাজেয়াপ্ত করেছে পুলিশ। রাত ১টা নাগাদ বাড়ি থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে প্রসূন এবং প্রণয় বিভিন্ন রাস্তায় ঘোরার যে বর্ণনা পুলিশকে দিয়েছিলেন, কিশোরের বয়ানের সঙ্গে তা মিলে গিয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে। কিশোর পুলিশকে জানিয়েছে, দুর্ঘটনার আগে তাকে সিট বেল্ট খুলে দিতে বলা হয়েছিল। এমনকি, পিলারে ধাক্কা দেওয়ার মুহূর্তে রাস্তায় আর কোনও গাড়ি ছিল না বলে সে পুলিশকে জানিয়েছে।

মঙ্গলবার রাতে ই এম বাইপাসে অভিষিক্তা মোড়ের কাছে পিলারে গাড়ি ধাক্কা দেওয়ার পরে গাড়িতে থাকা প্রণয়, প্রসূন এবং তাঁর ভাইপোকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। হাসপাতালে এত দিন ভর্তি থাকলেও দুই ভাইয়ের পরিবারের সদস্যদের কেউ এত দিন হাসপাতালে দেখা করতে যাননি বলে খবর। শনিবার প্রণয় দে-কে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। যদিও তার পরে দীর্ঘ ক্ষণ তিনি হাসপাতালেই ছিলেন। অস্থি শল্য চিকিৎসক দীপাঞ্জন ভদ্র, ক্রিটিক্যাল কেয়ারের ডাক্তার রিমিতা দে-সহ শল্য ও শিশু রোগ চিকিৎসকেরা প্রণয় এবং তাঁর ছেলের চিকিৎসা করছিলেন। জানা যাচ্ছে, নাবালকটির ডান হাতের কব্জি এবং বাঁ কাঁধের যেখানে গভীর ক্ষত ছিল, সেখানে হাড় ভেঙেছিল। ডাক্তারদের অনুমান, তীক্ষ্ণ ধারালো অস্ত্র দিয়ে ওই আঘাতে গভীর ক্ষতের পাশাপাশি হাড়ও ভাঙে।

হাসপাতাল সূত্রের খবর, ১২ বছরের ওই নাবালকের বাঁ কাঁধের সংযোগস্থলের হাড় ভেঙেছিল। অস্ত্রোপচার করে রড ঢুকিয়ে সেটি ঠিক করা হয়েছে। ডান হাতের কব্জির ভাঙা হাড় তার দিয়ে জোড়া হয়েছে। গাড়ি দুর্ঘটনার কারণে নাবালকটির হিপ-জয়েন্ট এবং গলার হাড় (কলার বোন) ভেঙেছিল। তবে অস্ত্রোপচার করতে হয়নি। দুর্ঘটনার অভিঘাতে প্রণয়ের ডান দিকের হিপ-জয়েন্ট পুরো ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু তাঁর অস্ত্রোপচার করা যায়নি। প্রচুর রক্তক্ষরণে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যাওয়ায় প্রণয়কে রক্ত দিতে হয়। হিপ-জয়েন্টের হাড় জোড়ার জন্য প্রণয়কে ‘স্কেলেটাল পিন ট্র্যাকশন’ দেওয়া হয়েছে। নাকেও আঘাত ছিল। সেটিও সাধারণ চিকিৎসাতেই সারবে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। দীপাঞ্জন বলেন, “প্রণয়কে মাস দেড়েক পরে আবার ফলোআপে আসতে বলা হয়েছে।”

বেসরকারি হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়া হলেও প্রণয়কে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হবে বলে আগেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানায় পুলিশ। সেই মতো ওই মেডিক্যাল কলেজের অস্থি বিভাগে তাঁকে ভর্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। যদিও হাসপাতাল থেকে এনআরএসে নিয়ে আসতে দিনভর টানাপড়েন চলে। তবে বেডের ব্যবস্থা না হওয়ায় তাঁর পুত্রকে ছাড়েননি বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

এ দিন হাসপাতালের তরফে জানানো হয়েছে, চার দিনে প্রণয় এবং তাঁর ছেলের চিকিৎসা বাবদ পাঁচ লক্ষের বেশি টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু তার জন্য হাসপাতালে কোনও টাকা জমা করা হয়নি। ঘটনার কথা হাসপাতালের তরফে ট্যাংরা এবং আনন্দপুর থানাকে জানানোর পাশাপাশি আহতদের পারিবারিক বন্ধুদেরও জানানো হয়। এ দিন সকাল ১০টা থেকে প্রণয়কে ছেড়ে দেওয়ার সমস্ত প্রক্রিয়া শেষ করা হয়েছিল হাসপাতালের তরফে।

একাধিক প্রশ্নের উত্তর অবশ্য এখনও অধরা। দুই স্ত্রীর শিরা কে কেটেছিলেন, তা এখনও জানতে পারেনি পুলিশ। নিশ্চিত হতে দুই ভাইকে একসঙ্গে বসিয়ে কথা বলতে চান তদন্তকারীরা। ইতিমধ্যেই পুলিশের কাছে দুই ভাই-ই আলাদা দাবি করেছিলেন, সবাই মিলে একসঙ্গে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তা হলে ঘরের ভিতরের সিসি ক্যামেরা সব বন্ধ করলেন কেন, উত্তর নেই এই প্রশ্নের। লালবাজারের এক কর্তা বলেন, “দুই ভাইকে মুখোমুখি বসালে একটা জটিলতা কাটতে পারে। সেই মতো পরিকল্পনা করা হচ্ছে। দু’জনের শারীরিক অবস্থার আরও কিছুটা উন্নতি হলে পরবর্তী পদক্ষেপ করা হবে।”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Tangra Murder Case Tangra Case police investigation

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy