Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বাজির শব্দই দানব, কোর্টে বলবে পর্ষদ

ছিপিবন্ধ অবস্থায় নিরীহ বোতল। ছিপি খুললেই কী ভাবে দানবের আবির্ভাব হয়, তা দেখিয়েছে আরব্য উপন্যাস। আমোদের বাজি থেকে শব্দ কী ভাবে দৈত্য হয়ে পীড়ন করছে, পরিবেশ আদালতে সেটা দেখাতে চাইছে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ।

সুরবেক বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৫ ০২:৫৭
Share: Save:

ছিপিবন্ধ অবস্থায় নিরীহ বোতল। ছিপি খুললেই কী ভাবে দানবের আবির্ভাব হয়, তা দেখিয়েছে আরব্য উপন্যাস। আমোদের বাজি থেকে শব্দ কী ভাবে দৈত্য হয়ে পীড়ন করছে, পরিবেশ আদালতে সেটা দেখাতে চাইছে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ।

উৎসবের মরসুমে শব্দবাজির দৌরাত্ম্য কী দুঃসহ হয়ে ওঠে, বঙ্গবাসী তা জানেন। মাঝখানে বেশ কিছু দিন তার দাপট কমেছিল সরকারি তৎপরতা আর আমজনতার কিঞ্চিৎ সচেতনতায়। কিন্তু ইদানীং আবার সেই শব্দযন্ত্রণা ফিরেছে বাংলায়।

কতটা ফিরেছে এবং কেন তাকে দমন করা দরকার, সমীক্ষা চালিয়ে পাওয়া সেই পরিসংখ্যান জাতীয় পরিবেশ আদালতে তুলে ধরতে চাইছে পশ্চিমবঙ্গে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ।

এ বার কালীপুজো ও দেওয়ালিতে সন্ধ্যা থেকে রাত— শব্দ মাপার যন্ত্রে ডেসিবেলের অঙ্ক অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। অন্যান্য দিন গড়ে ৫০ ডেসিবেলের সামান্য বেশি থাকলেও ওই দু’দিন শব্দমাত্রা ছিল ৭০ বা তার চেয়েও বেশি। বাগবাজার বা বিরাটির মতো বসত এলাকায় বসানো পর্ষদের শব্দ পরিমাপক যন্ত্রে শব্দমাত্রার এই বৃদ্ধি ধরা পড়েছে। শুধু মহানগর নয়, বিভিন্ন জেলায় বসানো শব্দ-মাপক যন্ত্রে একই অবস্থার প্রতিফলন ঘটেছে বলে জানাচ্ছেন পর্ষদকর্তারা।

শব্দবাজির প্রত্যাবর্তন প্রতিরোধে আদালতে নিজেদের লড়াইটা লড়তে এই তথ্যই পর্ষদের অন্যতম হাতিয়ার। তাদের দাবি, শুধু ওই দু’দিন বহু বসত এলাকায় প্রচণ্ড শব্দ সৃষ্টি করে যন্ত্রণা দেওয়ার খলনায়ক শব্দবাজি। সেই জন্যই এতটা ফারাক হয়ে যাচ্ছে শব্দের প্রাবল্যে। এক-একটি এলাকার জন্য কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রকের বেঁধে দেওয়া গড় শব্দমাত্রার তুলনায় সেটা ১৫, ২০ ডেসিবেল বেড়ে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও সেই বৃদ্ধির মাত্রা তার চেয়েও বেশি।

এ বার কালীপুজো ছিল ১০ নভেম্বর আর দেওয়ালি ১১ নভেম্বর। দু’দিনই সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কলকাতা তথা রাজ্যের বিভিন্ন বসত ও বাণিজ্যিক এলাকা আর শিল্পাঞ্চলের পারিপার্শ্বিক শব্দমাত্রা রেকর্ড করেছে পর্ষদের যন্ত্র। আবার কালীপুজোর আগের আট দিনে একই সময়ে ওই সব এলাকার শব্দমাত্রা নেওয়া হয়েছে। ওই নির্দিষ্ট সময়ে শব্দমাত্রা রেকর্ড করে রাখার কারণ, সাধারণত সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টার মধ্যেই বাজির ব্যবহার বেশি হয় বলে পর্ষদকর্তাদের পর্যবেক্ষণ।

বাগবাজারে কালীপুজোর আগের আট দিন ওই সময়ে পারিপার্শ্বিক শব্দমাত্রার গড় ছিল ৫৩.৮ ডেসিবেল। কিন্তু কালীপুজোর দিন ওই একই সময়ে শব্দমাত্রার গড় ৭৪.৪৮ ডেসিবেল। দেওয়ালিতে সেটা হয়েছে ৭৭.৪৮। বিরাটিতে কালীপুজোর আগের আট দিন ওই সময়ে পর্ষদের যন্ত্রে রেকর্ড করা পারিপার্শ্বিক শব্দমাত্রা ছিল ৫১.৪৪ ডেসিবেল। অথচ কালীপুজোর দিন সেটাই বেড়ে হয়ে যায় ৬৭.৭৭ এবং দিওয়ালিতে ৬২.৮৩ ডেসিবেল।

অথচ নিউ মার্কেটের বাণিজ্যিক এলাকায় কিংবা তারাতলা শিল্পাঞ্চলে কালীপুজো, দেওয়ালির সঙ্গে সাধারণ দিনের শব্দমাত্রার ফারাক অনেক কম। নিউ মার্কেটে কালীপুজোর আগে এক সপ্তাহে পারিপার্শ্বিক শব্দমাত্রা ছিল ৮৭.৫২ ডেসিবেল। ১০ নভেম্বর তা সামান্য বেড়ে হয় ৯০.৯০ এবং তার পরের দিন আর একটু বেড়ে হয় ৯১.১০। তারাতলায় অন্যান্য দিনে থাকে শব্দমাত্রা ৫৯.৮২ ডেসিবেল। কালীপুজোর রাতে ৬৩.১০। দেওয়ালিতে ৬১.৪১ ডেসিবেল।

পর্ষদের এক বিজ্ঞানীর ব্যাখ্যা, বাণিজ্যিক এলাকা ও শিল্পাঞ্চল হল কাজের জায়গা। কালীপুজো ও দেওয়ালিতে সেখানে বাজি তেমন ফাটেনি। বরং ওই সব জায়গা থেকে অনেকেই নিজেদের বাড়িতে বা বসত এলাকায় গিয়ে শব্দবাজি ফাটিয়েছেন। সেই জন্য ওই দু’দিন শব্দমাত্রার ফারাকটা বসত এলাকায় খুব বেশি।

ওই বিজ্ঞানী বলেন, ‘‘২০০০ সালের শব্দবিধি অনুযায়ী কোনও বিশেষ কার্যকলাপের কারণে কোনও এলাকার পারিপার্শ্বিক শব্দমাত্রা ১০ ডেসিবেল বা তার বেশি বেড়ে গেলে সেই কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে। শব্দমাত্রা এতটা বাড়ার কারণ শব্দবাজি। কাজেই শব্দবাজি নিষিদ্ধ করলেই সুরাহা মিলবে। এটাই আমরা পরিবেশ আদালতে জানাব।’’

শব্দবাজি নিষিদ্ধ করা কেন দরকার, বিজ্ঞানসম্মত সমীক্ষার মাধ্যমে সেটা বোঝাতে আদালতের নির্দেশে পর্ষদ একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গড়েছে। আট সদস্যের ওই কমিটির চেয়ারম্যান কান-নাক-গলার বিশেষজ্ঞ-চিকিৎসক দুলাল বসু। ওই কমিটির সঙ্গে ১১ ডিসেম্বর বৈঠকে বসবেন পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র। তিনি বলেন, ‘‘কালীপুজো আর দেওয়ালিতে রাজ্যের বিভিন্ন বসত এলাকায় যে-শব্দমাত্রা আমাদের যন্ত্রে ধরা পড়েছে, তার সঙ্গে সাধারণ দিনের পার্থক্যই বলে দেয়, কেন শব্দবাজি নিষিদ্ধ হওয়া জরুরি।’’

পর্ষদের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য আইন আধিকারিক বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, বর্ষশেষের রাত তথা বর্ষবরণ উৎসবেও বিকট শব্দের বাজি ফাটানো ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা ছাড়া আছে খেলা, সামাজিক উৎসব। তাঁর কথায়, ‘‘সারা বছর লড়াইয়ের কথা ভেবেই প্রস্তুত হতে হবে পর্ষদকে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE