E-Paper

‘মাদক তৈরির গন্ধ ঢাকতে খরচ আলাদা’

মাদকের বড় চক্র নয়, এরা খুচরো কারবারি। নিজেরাই মাদক তৈরি করে, বেচেও। রাজ্যে প্রতিপক্ষ, রাজনীতি, পুলিশ, নার্কোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরো সামলে কী ভাবে চলছে কারবার।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০২৫ ০৬:১৭

—প্রতীকী চিত্র।

এ রাজ্যে মাদক কারবারের কুটিরশিল্পে মোটামুটি তিনটি ধাপ। এক, পোস্তর আঠা আমদানি। দুই, দেশি পদ্ধতিতে (ফর্মুলা) মাদক তৈরি। এবং সর্বোপরি, ‘মাল’ তৈরি হলে তা গ্রাহককে পৌঁছে দেওয়া। কাঁচামাল আনা আর তৈরি ‘মাল’ পাচারের জন্য দু’ধরনের ‘ডেলিভারি বয়’ বা ‘কেরিয়ার’ রয়েছে। আর রয়েছে তারা, যারা ‘উচ্চ মানের’ মাদক বানাতে জানে। ব্যবসায় কাঁচা মালের জন্য লগ্নি ছাড়া, অন্যতম খরচএদের পারিশ্রমিকের।

তা ছাড়া, মাদক বানানোর সময়ে অনেক ক্ষেত্রে রাসায়নিকের কড়া গন্ধ পাওয়া যায়। ‘‘সে গন্ধ ঢাকা দিতে আলাদা খরচ আছে,’’ বলছে জলপাইগুড়ির ‘রাজা’। কিছু কিছু ছোট কারবারি যেমন জনবসতি থেকে দূরে ডেরা বানায়, রাজা জানাচ্ছে, তারা বেছে নেয় ঘনবসতি এলাকা। বিশেষত, এমন এলাকা, যেখানে নিকাশির পাকা নালা নেই। কাঁচা ড্রেন থেকে প্রায় সারাক্ষণই দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। যে সব এলাকায় শুয়োর চরে, কাদা জমে থাকে, বছরভর নাকে রুমাল চাপা দিতে হয়। তেমন কোনও এক জায়গায় মেশানো হয় রাসায়নিক। এর পরেও নালার দুর্গন্ধ ছাপিয়ে কেউ যদি রাসায়নিকের গন্ধ পান, তা ‘ঢাকা’ দেওয়ার অন্য ব্যবস্থা আছে।

কেমন সে ব্যবস্থা? আশপাশের বাড়ির পুরুষদের নেশা করার টাকা দেওয়া হয়, মহিলাদের জন্য কাপড়-গয়নার বন্দোবস্ত থাকে, কচিকাঁচাদের পড়ার খরচ জোগানো হয়, তাদের বাবা-মা-কে, কিশোরদের মোবাইল ‘রি-চার্জ’ করে দেওয়া হয় নিয়মিত। এই সব মিলিয়ে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট টাকা ব্যয় করে মাদক কারবারিরা। লাভ? ঘনবসতি এলাকায় চট করে পুলিশের গাড়ি ঢোকে না। পায়ে হেঁটে পুলিশকর্মীরা পৌঁছনোর আগেই, কারবারিরা স্থানীয় ‘নেটওয়ার্ক’ থেকে খবর পেয়ে যায়।

রাসায়নিকের গন্ধে যাতে আশেপাশের কারও সন্দেহ না হয়, এক এক জেলায় এক এক রকম ব্যবস্থা। কোচবিহারে গ্রামে মাদক বানাতে এমন এলাকা বাছা হয়, যেখানে দু’টি বাড়ির মধ্যে যথেষ্ট ব্যবধান রয়েছে। নদিয়া এবং মালদহে মাদক বানানোর জন্য কারবারিদের প্রথম পছন্দ, গ্রামের পাশের মাঠ বা কোন বাগান-জঙ্গলের ভিতরে ফাঁকা জায়গা। সব ক্ষেত্রেই স্থানীয় ভাবে প্রভাবশালী বা শাসক দলের ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকার চেষ্টা করে মাদক কারবারিরা। সে জন্য ‘প্রণামী’ দিতে তারা পিছপা নয়।

তবে মাদকের ব্যবসায় খরচ শুধু রাসায়নিকের গন্ধ চাপা দেওয়ার জন্য হয়, এমন নয়। মাদকের বড় কারবারিদের লভ্যাংশে ভাগ বসায় ছোট কারবারিরা। তা ছাড়া, তাদের নিজেদের মধ্যেও এলাকার দখল নিয়ে ঝগড়া লেগে থাকে। কালিয়াচকের এক মাদক কারবারির দাবি, ‘‘কারবারে এখন শত্রু বাড়ছে। নিজের দলকে বাঁচাতে হাতে কিছু অস্ত্রধারী ছেলেও রাখতে হচ্ছে। তাদের খাওয়ার খরচা, বন্দুক-গুলি জোগানের খরচও রয়েছে।” কোচবিহারের এক কারবারির দাবি, নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী রাখতে মাসে প্রায় এক লক্ষ টাকা খরচ করে সে।

এমন ব্যবস্থাপনার দৌলতে ডুয়ার্সের পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা মালবাজারে সন্ধ্যা নামলেই জ্বলে মাদকসেবীদের রাংতার আগুন। রাতে গঞ্জের মাঝে রেললাইন আর সুনসান রাস্তায় নেশার আসর বসে। ধূপগুড়ি, বানারহাটের কিছু জায়গায় রাস্তার পাশে বিক্রি হয় নেশার জিনিস। টাউন স্টেশন লাগোয়া বস্তির অনেকে এই কারবারে জড়িত।

এই বিক্রির ‘তীর্থক্ষেত্র’ সাধারণত খুব উল্টো রকমের দুই জায়গা। প্রথমত, ফাঁকা-ফাঁকা গাঁ-গঞ্জ, লোকসমাগম কম। যেমন, নদিয়ার বড় নলদহ বা ডুয়ার্সের মালবাজার। দ্বিতীয় ক্ষেত্রটি ঠিক এর উল্টো, যেখানে বিপুল লোকসমাগম হয় এবং সে কারণে নজরদারি শক্ত। যেমন, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ঘুটিয়ারি শরিফ লাগোয়া এলাকা। এখানে মাদক তেমন তৈরি হয় না। কিন্তু পাইকারি হারে মাদক কিনে খুচরো বেচার কারবার প্রায় ঘরে-ঘরে। মুর্শিদাবাদ-নদিয়া থেকে হেরোইন এনে অতিরিক্ত মুনাফার জন্য তার সঙ্গে পাউডার-জাতীয় ভেজাল মিশিয়ে ছোট পুরিয়ায় বিক্রি করা হয় বলে খবর। ঘুটিয়ারি শরিফে বহু মানুষ আসেন। সে ভিড়ে মিশে মাদকের কেনাবেচা চলে। হুগলির পান্ডুয়া স্টেশন চত্বর, বালিহাট্টা, সিমলাগড়, মাঠপাড়ায় মোবাইল যোগাযোগের মাধ্যমে কারবার চলে। নদিয়া-সংলগ্ন উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁয় মোবাইলে ‘অর্ডার’ দিলে পৌঁছে যায় পুরিয়া, এমনই দাবি ওয়াকিবহালদের। বসিরহাট মহকুমার বাদুড়িয়া, মাটিয়া, স্বরূপনগর, সন্দেশখালিতে, বিশেষত বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় কার্যত প্রশাসনের নাকের ডগায় এই কারবার চলছে বলে অভিযোগ। এলাকার বাসিন্দাদের ক্ষোভ, ‘‘মাঝে-মাঝে লোক দেখানো দু’-একটা ধরপাকড় হয়। দু’-এক ঘণ্টার মধ্যে ছাড়াওপেয়ে যায় তারা। পড়ুয়া থেকেশুরু করে শ্রমিকদের একাংশ নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন।’’

(চলবে)

তথ্য অনুসন্ধানে: অনির্বাণ রায়, সুস্মিত হালদার, নমিতেশ ঘোষ, সীমান্ত মৈত্র, অভিজিৎ সাহা, দয়াল সেনগুপ্ত, সামসুদ্দিন বিশ্বাস, নির্মল বসু, সামসুল হুদা, প্রসেনজিৎ সাহা, পীযূষ নন্দী, শুভঙ্কর পাল,সুশান্ত সরকার।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Illegal drugs

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy