কে কেমন পড়ছেন, কার কেমন অগ্রগতি, আবহমান কাল থেকে পড়ুয়াদের সেই মূল্যায়নের দায়িত্ব তাঁদের হাতে। কিন্তু তাঁরা অর্থাৎ শিক্ষকেরা কে কেমন পড়াচ্ছেন, তার মূল্যায়ন কে বা কারা করবেন?
শিক্ষকদের মূল্যায়ন করতে হবে ছাত্রছাত্রীদেরই। বলছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। নতুন কথা নয়। আগেও বলা হয়েছে। কিন্তু তেমন ভাবে বলবৎ হয়নি সেই ব্যবস্থা। এ বার সব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের হাতে শিক্ষক-মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে চাইছে ইউজিসি।
২০১০ সালেই ইউজিসি প্রথম এমন প্রস্তাব দেয় দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়কে। কিন্তু শিক্ষকদের মার্কশিটে ছাত্রছাত্রীরা নম্বর বসাবেন, এমন বন্দোবস্ত বাস্তবায়িত করার সাহসই দেখায়নি অধিকাংশ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ রাজ্যে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় এই পদ্ধতি চালু করতে উদ্যোগী না-হলেও কিছু কলেজ অবশ্য ন্যাশনাল অ্যাসেসমেন্ট অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল (নাক)-এর সফরের আগে ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে শিক্ষক-মূল্যায়নের ব্যবস্থা চালু করেছে। কিন্তু কলেজগুলির পক্ষে এই পদ্ধতির সুফল বা কুফল সে-ভাবে বোঝা সম্ভব হয়নি। বিপরীতমুখী এই মূল্যায়নের সুবিধা-অসুবিধাগুলোও আবছা অবস্থাতেই রয়ে গিয়েছে।
ইউজিসি-র সূত্র অবশ্য জানাচ্ছে, ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মূল্যায়নের ব্যবস্থা যথাযথ ভাবে কার্যকর হলে তাতে পড়ুয়া ও শিক্ষক উভয় পক্ষেরই দায়বদ্ধতা বাড়তে বাধ্য। তাই তাদের পরবর্তী নির্দেশিকায় এই পদ্ধতি বাধ্যতামূলক করার কথা ভাবা হচ্ছে।
এক জন পড়ুয়া কী ভাবে মূল্যায়ন করবেন তাঁর শিক্ষক বা শিক্ষিকার?
বছর ছয়েক আগের প্রস্তাবেই সেই মূল্যায়ন-পদ্ধতির রূপরেখা দিয়েছিল ইউজিসি। সেই প্রস্তাবে বলা হয়, প্রতি বছর যেমন পরীক্ষার মাধ্যমে পড়ুয়াদের মূল্যায়ন হয়, সেই ভাবে শিক্ষকদেরও যেতে হবে একটি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে। শিক্ষকেরা ক্লাসে কেমন পড়ান, প্রত্যেক পড়ুয়ার সঙ্গে লেখাপড়ার সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে কেমন ভাবে আলোচনা করেন, এমনই সব বিষয়ের ভিত্তিতে শিক্ষক বা শিক্ষিকাদের মূল্যায়ন করবেন ছাত্রছাত্রীরা। সেই নিয়ম অনুয়ায়ী প্রতিটি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ বছরের পড়ুয়ারা একটি ফর্ম পূরণ করবেন। তাঁদের শিক্ষাবর্ষের শেষ পরীক্ষার ফর্ম পূরণের সময় শিক্ষক-মূল্যায়নের ফর্মও দেওয়া হবে। সেটি পূরণ করে জমা দিলে তবেই পরীক্ষায় বসার ফর্ম পূরণ করতে পারবেন তাঁরা। অর্থাৎ পড়ুয়াদের পরীক্ষার সঙ্গে শিক্ষকদের পরীক্ষাকে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল নিয়মের বাঁধনে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, রাজ্যের অধিকাংশ কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়েই একসঙ্গে শিক্ষক ও পড়ুয়ার এই উভমুখী মূল্যায়নের অস্তিত্ব নেই!
কেন নেই?
আসলে ওই প্রস্তাব আসার পরেই শিক্ষকমহলে শুরু হয় বিতর্ক। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একাংশের বক্তব্য, পড়ুয়ারা শিক্ষকদের মূল্যায়ন করলে অনেকাংশেই তা পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে। শুধু তা-ই নয়, পড়ুয়াদের হাতে নম্বর পেতে হলে রাজনৈতিক ভাবেও সমস্যায় পড়তে হতে পারে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের। রাজনৈতিক মতাদর্শ ভিন্ন হলে পড়ুয়ারা তাঁদের মূল্যায়নের অধিকারটিকে ব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক বা শিক্ষিকার পদোন্নতি পর্যন্ত আটকে দিতে পারেন।
শিক্ষকদের অন্য একটি অংশ অবশ্য ইউজিসি-র প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁদের মতে, শিক্ষার মানোন্নয়নে এই মূল্যায়নের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বাধা যেটুকু আছে, সেটা আসলে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মানসিকতার। আবহমান কাল ধরে উঁচু স্থানে থেকে তাঁরা ছাত্রছাত্রীদের মূল্যায়ন করে আসছেন। পড়ুয়ারা তাঁদের মূল্যায়ন করতে বসলে সেই চিরাচরিত সামাজিক ব্যবস্থা টাল খাবে বলে মনে করছেন তাঁরা। তাঁদের অনেকের কাছেই এটা মানহানিকর। কিন্তু শিক্ষার উন্নয়নের স্বার্থে এই মানসিকতার বদল দরকার। তাই ইউজিসি-র প্রস্তাব মাননীয় বলে মনে করছেন শিক্ষকদের একটি অংশ।
যেমন নিউ আলিপুর কলেজের অধ্যক্ষ সুজিত দাস জানাচ্ছেন, প্রতি বছরই তাঁরা পড়ুয়াদের দিয়ে শিক্ষকদের মূল্যায়ন করান। যে-সব শিক্ষক কম নম্বর পান, তাঁদের ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়?
বিষয়টিকে মোটেই পরীক্ষায় নম্বর দেওয়ার মতো করে দেখতে রাজি নন সুজিতবাবু। তিনি বলেন, ‘‘এই মূল্যায়ন আদতে পঠনপাঠনকেই আরও মজবুত করে। পড়ুয়াদের নাম এ ক্ষেত্রে গোপন থাকে। কিন্তু তাঁরা যে-সব সমস্যার উল্লেখ করেন, সেগুলো নিয়ে সবিস্তার আলোচনা হয়। ফলে পরবর্তী ক্ষেত্রে পড়াশোনার উত্কর্ষ বাড়াতে সুবিধা হয়।’’ কিন্তু ওই কলেজেরই কিছু শিক্ষকের প্রশ্ন, ‘‘যে-সব ছাত্রছাত্রী বছরের অধিকাংশ সময় ক্লাসেই আসেন না, তাঁরা শিক্ষকদের মূল্যায়ন করবেন কী ভাবে?’’ সুজিতবাবু মনে করেন, এই ব্যবস্থা কার্যকর হলে পড়ুয়ারাও নিয়মিত কলেজে আসতে বাধ্য হবেন। কারণ, কোন ছাত্র বা ছাত্রী ক’টি ক্লাস করেছেন, তার উল্লেখ করতে হবে নির্দিষ্ট ফর্মে। অর্থাৎ ছাত্রছাত্রীদের বাধ্যতামূলক হাজিরার ক্ষেত্রেও এই ব্যবস্থার গুরুত্ব আছে। ব্যারাকপুরের রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ কলেজের অধ্যক্ষা তথা ওয়েবকুপা-র সভানেত্রী কৃষ্ণকলি বসু বলেন, ‘‘ইউজিসি-র নির্দেশ মেনে আমরা এই ব্যবস্থা চালু করেছি। কোনও সমস্যা হচ্ছে না।’’
কিন্তু শিক্ষকদের ব্যক্তিগত কোচিং ক্লাসে পড়ানোর বিষয়টিও এই মূল্যায়নের বিষয়টি হাল্কা করে দিতে পারে বলে মনে করেন শিক্ষকদের বড় একটি অংশ। এক শিক্ষকের প্রশ্ন, ‘‘যে-শিক্ষক কলেজের বাইরেও শিক্ষকতা করেন, তাঁর মূল্যায়ন করতে গিয়ে তাঁর কোচিংয়ে পড়া পড়ুয়ারা কি পক্ষপাত করবেন না?’’ অসুবিধা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কলেজ শিক্ষকদের একটি সংগঠনের এক নেতা জানান, ছাত্রছাত্রীরা সারা বছর কেমন পড়াশোনা করেন, পরীক্ষার মাধ্যমেই তার বিচার করা হয়। তেমনই যিনি পড়াচ্ছেন, তিনি নিজের কাজের প্রতি কতটা দায়বদ্ধ, কী ভাবে পেশাগত সততা বজায় রাখছেন— সেগুলোরও একটা মাপকাঠি প্রয়োজন। শিক্ষক-পড়ুয়া বোঝাপড়ায় শিক্ষার মান যাতে উন্নত হয়, সেই ভাবনা থেকেই ইউজিসি-র এই সিদ্ধান্ত। কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে মনে হচ্ছে, প্রস্তাবটি অবাস্তব।
রাজ্যের সরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতির সম্পাদক দেবাশিস সরকার বলেন, ‘‘কোনও পরিকল্পনা রূপায়ণ করতে হলে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখা উচিত। শুধু পশ্চিমবঙ্গ কেন, সারা ভারতে কোথাও এমন পরিস্থিতি নেই, যাতে পড়ুয়ারা শিক্ষকদের মূল্যায়ন করতে সক্ষম।’’ ইউজিসি-র এই প্রস্তাবের পিছনে রাজনৈতিক অভিসন্ধি দেখছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠন আবুটা-র আহ্বায়ক গৌতম মাইতি। তিনি বলেন, ‘‘ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে শিক্ষকদের মূল্যায়ন করানোর সঙ্গে শিক্ষকদের পদোন্নতির বিষয়টিকেও জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা মূল্যায়ন করবে, এটা ভাল দিক। কিন্তু তাতে সরাসরি শিক্ষকদের প্রোমোশনকে জুড়ে দেওয়াটা আদৌ মেনে নেওয়া যায় না। কারণ, এতে বিশেষ কোনও রাজনৈতিক দল নিজেদের প্রভাব খাটাতে পারে।’’
একই সুরে আপত্তি তুলেছেন পশ্চিমবঙ্গ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ওয়েবকুটা-র সাধারণ সম্পাদক শ্রুতিনাথ প্রহরাজ। ‘‘বর্তমান পরিস্থিতিতে তো পড়ুয়ারাই শিক্ষক-নিগ্রহে সরাসরি জড়িয়ে পড়ছেন। তাঁদের হাতে শিক্ষকের বিচার হবে? এবং তার ভিত্তিতে শিক্ষকের পদোন্নতি হবে? এটা মানা যায় না,’’ বলছেন শ্রুতিনাথবাবু।
মানসিকতা, মানসম্মানের প্রশ্ন বা রাজনীতি— কোনওটাই এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হতে পারে বলে মনে করেন না প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায়। তাঁর বিশ্বাস, ‘‘শিক্ষক যদি ভাল হন এবং রাজনীতি না-করেন, পড়ুয়ারা তাঁকে সম্মান করবেই। ছাত্রদের এই মূল্যায়ন ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।’’ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অশোকনাথ বসুও এই বিষয়ে একমত। ‘‘এই মূল্যায়ন পদ্ধতির খুবই প্রয়োজন।
এটা শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরই আরও এগিয়ে থাকতে সাহায্য করবে,’’ বলছেন অশোকবাবু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy