Advertisement
০২ মে ২০২৪
প্রায় চার বছর পর ফিরে দেখা রাজ্যের সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল

হাসপাতাল হলেই হত, সমস্যা ‘সুপার’ তকমায়

প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি জেলা স্তরে এত হাসপাতাল গড়ার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল? প্রবীণ চিকিৎসকদের একাংশ বলছেন, তা একেবারেই নয়।

কেন্দ্রের ‘ব্যাকওয়ার্ড রিজিয়ন ডেভলপমেন্ট ফান্ডে’ টাকার অভাব নেই।  সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের খাতে সেই টাকার অনেকটা খরচ হচ্ছে। প্রতীকী ছবি।

কেন্দ্রের ‘ব্যাকওয়ার্ড রিজিয়ন ডেভলপমেন্ট ফান্ডে’ টাকার অভাব নেই। সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের খাতে সেই টাকার অনেকটা খরচ হচ্ছে। প্রতীকী ছবি।

সোমা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০১৯ ০৪:৪১
Share: Save:

বহু জায়গাতেই এখনও খাটের প্লাস্টিক পর্যন্ত খোলা হয়নি। যন্ত্র পড়ে রয়েছে বাক্সেই। দামি মার্বেলের মেঝেতে ধুলো। হাসপাতালের গায়ে সুপার স্পেশ্যালিটি বোর্ড জ্বলজ্বল করছে ঠিকই, কিন্তু রোগীরা এসে প্রয়োজনীয় ওষুধটুকুও পাচ্ছেন না।

কেন্দ্রের ‘ব্যাকওয়ার্ড রিজিয়ন ডেভলপমেন্ট ফান্ডে’ টাকার অভাব নেই। সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের খাতে সেই টাকার অনেকটা খরচ হচ্ছে। ‘‘কিন্তু শুধু হোটেল-হোটেল চেহারা হলে তো চলবে না। চিকিৎসাটা তো চাই।’’ বলছিলেন জঙ্গিপুরের এক স্কুল শিক্ষক। তাঁর কথায়, ‘‘যখন হাসপাতাল খোলার কথা শুনেছিলাম, প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। এখন বুঝছি, তার অনেকটাই ফাঁকি। নিজের সম্বল বুঝে এগোনো উচিত ছিল সরকারের।’’

প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি জেলা স্তরে এত হাসপাতাল গড়ার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল? প্রবীণ চিকিৎসকদের একাংশ বলছেন, তা একেবারেই নয়। দরকার ছিল সাধারণ হাসপাতাল। যেখানে মানুষ নির্দিষ্ট ধাপ পর্যন্ত চিকিৎসা পাবেন। কিন্তু সুপার স্পেশ্যালিটি তকমার প্রয়োজন ছিল না। যতগুলো হাসপাতাল তৈরি হয়েছে, তাতে রাজ্যের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সোনা ফলে যাওয়ার কথা। কিন্তু ‘অসত্য দাবি’ করতে গিয়ে অনেক কিছু হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে তাঁদের অভিযোগ।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

চিকিৎসক মহলের বড় অংশের মতে, ৩০ লক্ষ টাকার বন্ডের ভয় দেখিয়ে হাসপাতালে বেঁধে রাখা যেতে পারে। কিন্তু উন্নত পরিষেবা দিতে বাধ্য করা যায় কি? প্রশ্ন উঠেছে, যে চিকিৎসকদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তাঁদের সেখানে থাকার জন্য কী পরিকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে? কেন এ ক্ষেত্রে বদলি নীতিতে কিছুটা পরিবর্তন করা হচ্ছে না? ফালাকাটায় কর্মরত এক চিকিৎসক বলেন, ‘‘আমার বাড়ি বাঁকুড়ায়। বার বার অনুরোধ করেছিলাম, ওখানকার কোনও হাসপাতালে আমার পোস্টিং দেওয়া হোক। আমার মতো আরও অনেকেই স্থানীয় এলাকায় পোস্টিং চেয়েছিলেন। তাতে অন্তত থাকার পরিকাঠামোগত সমস্যাটা কমত। সেটা হয়নি। বরং অনেক ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যকর্তাদের আচরণ দেখে মনে হয়েছে, তাঁরা যেন শাস্তিমূলকভাবে আমাদের বদলির ব্যবস্থা করছেন।’’

প্রশ্ন যেখানে

• কেন ডাক্তার-নার্সদের থাকার যথাযথ পরিকাঠামো তৈরি হচ্ছে না?
• চুক্তির ভিত্তিতে পর্যাপ্ত চতুর্থ শ্রেণির কর্মী কেন নিয়োগ হয়নি?
• টেকনিশিয়ান নিয়োগের ব্যবস্থা না করে কেন মূল্যবান যন্ত্র ফেলে রেখে নষ্ট করা হচ্ছে?
• ২৪ ঘণ্টা পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য পিপিপি মডেল কেন যথাযথ কাজ করছে না?

একে ৪১টি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল। তার উপরে নতুন পাঁচটি মেডিক্যাল কলেজ। সেখানেও ডাক্তার এবং অন্যান্য কর্মীর ব্যবস্থা করতে হবে। বাস্তবিকই সব মিলিয়ে স্বাস্থ্য দফতরের ভাঁড়ে মা ভবানী অবস্থা। বেসরকারি হাসপাতাল থেকে ধার করে কিংবা অন্য মেডিক্যাল কলেজগুলি থেকে দৈনিক ভাতার বিনিময়ে ডাক্তারদের চেয়েচিন্তে এনেও সামলানো যাচ্ছে না। ফলে হাতে গোনা কয়েকটি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে উন্নত পরিষেবার ব্যবস্থা থাকলেও বেশির ভাগ হাসপাতালই আদতে মহকুমা বা গ্রামীণ হাসপাতালের মতো। কোথাও আবার গ্রামীণ হাসপাতালের যাবতীয় পরিকাঠামো তুলে এনে স্রেফ সুপার স্পেশ্যালিটি নাম দেওয়া হচ্ছে।

অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টর্স-এর তরফে মানস গুমটার অভিযোগ, ‘‘নিয়মিত আউটডোর হয়। অনেক রোগী আসেন। শয্যাও ভরে যায়। কিন্তু ব্লক স্তরের হাসপাতালে যে পরিষেবাটুকু মেলে, তার চেয়ে বেশি কিছু পাওয়া যায় না।’’

স্বাস্থ্যকর্তারা স্বীকার করেছেন, বেসরকারি হাসপাতাল থেকে এমনকি, ভিন রাজ্য থেকে ডাক্তারদের এ রাজ্যে আনার চেষ্টা হলেও তা সফল হচ্ছে না। এক কর্তার কথায়, ‘‘নিয়মের কড়াকড়ির জন্য বহু সরকারি ডাক্তার চাকরি ছাড়ছেন। ডাক্তারদের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে না। অনেকে ধার করে বন্ডের টাকা মিটিয়ে চাকরি ছাড়ছেন। পরিস্থিতি আরও খারাপ হলেও আশ্চর্য হব না।’’

তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে সঞ্জয় মিত্র স্বাস্থ্য সচিব থাকাকালীন সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল চালুর কথা ভাবা হয়। মূল পরিকল্পনা ছিল স্বাস্থ্য দফতরের উপদেষ্টা, চিকিৎসক সুব্রত মৈত্রের। সেই অনুযায়ী কয়েক ধাপে হাসপাতালগুলি তৈরি হয়। স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা প্রদীপ মিত্রের দাবি, ক্রমশ হাসপাতালগুলি স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠছে। তাঁর কথায়, ‘‘কিছু সমস্যা সব জায়গাতেই থাকে। কিন্তু মূল কথা হল, জেলার মানুষদের আর হাতুড়ে ডাক্তারদের উপরে ভরসা করতে হচ্ছে না। তাঁরা যথাযথ চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছেন। অস্ত্রোপচারের জন্য কয়েকশো কিলোমিটার দূরে ছুটতে হচ্ছে না।’’

কিন্তু ইমার্জেন্সি অস্ত্রোপচার? হার্ট, নার্ভ, লিভারের সমস্যা? ক্যানসারের চিকিৎসা? উত্তর মেলেনি।

স্বাস্থ্য ভবনের কর্তাদের কাছে নিজের সমস্যা জানাতে আসা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের এক ডাক্তার বললেন, ‘‘দুর্ঘটনায় পা ভাঙলে প্লাস্টারের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু যদি পায়ে প্লেট বসানোর প্রয়োজন পড়ে তা হলে রেফার করতে হবে। সুপার স্পেশ্যালিটি শব্দটা তখন পরিহাসের মতো শোনায়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Super Specialty Hospital Health
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE