Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

রফতানির লরি ঘিরে জুলুমের সিন্ডিকেট

এ-ও এক সিন্ডিকেট! তবে বাড়ি তৈরির ইট-বালি-সুরকি-সিমেন্টের নয়। এ হল গিয়ে আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরোনো পণ্যবাহী লরি থেকে তোলা আদায়ের সিন্ডিকেট। রাজারহাট-নিউটাউনের মতো বহু জায়গায় ইমারতি দ্রব্যের সিন্ডিকেট-রাজ যেমন আমগৃহস্থকে নাকানিচোবানি খাওয়াচ্ছে, তেমন বসিরহাটের ঘোজাডাঙায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে তোলা-শাসনে ব্যবসায়ীরা জেরবার।

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:২৪
Share: Save:

এ-ও এক সিন্ডিকেট!

তবে বাড়ি তৈরির ইট-বালি-সুরকি-সিমেন্টের নয়। এ হল গিয়ে আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরোনো পণ্যবাহী লরি থেকে তোলা আদায়ের সিন্ডিকেট। রাজারহাট-নিউটাউনের মতো বহু জায়গায় ইমারতি দ্রব্যের সিন্ডিকেট-রাজ যেমন আমগৃহস্থকে নাকানিচোবানি খাওয়াচ্ছে, তেমন বসিরহাটের ঘোজাডাঙায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে তোলা-শাসনে ব্যবসায়ীরা জেরবার। চাল থেকে মাছ, ফল থেকে লঙ্কা মাল সমেত লরি ও-পারে গেলেই নগদ প্রণামী গুনতে হচ্ছে। ফিরতি পথে খালি গাড়িকেও ছাড় দেওয়া হচ্ছে না!

এবং অভিযোগ: রাজারহাট-নিউটাউনের মতো উত্তর ২৪ পরগনায় এই সীমান্ত-সিন্ডিকেটের পিছনেও রয়েছে শাসকদল তৃণমূলের সমর্থনপুষ্ট একাধিক শ্রমিক ইউনিয়ন। ব্যবসায়ী মহলের হিসেবে, ঘোজাডাঙা দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকা লরির বহর থেকে তোলা বাবদ মাসে প্রায় ১ কোটি ৩৫ লক্ষ টাকা (বছরে ১৩ কোটি টাকার বেশি) আদায় হচ্ছে, যা কিনা বিবিধ পথে স্থানীয় প্রশাসন ও শাসকদলের বিভিন্ন স্তরে পৌঁছে যাচ্ছে বলে সূত্রের ইঙ্গিত। প্রতিকার চেয়ে পণ্য খালাসকারীরা প্রশাসনিক কর্তাদের সঙ্গে বারবার বৈঠকে বসেছেন। লাভ হয়নি। এমতাবস্থায় অনেক লরি-মালিক ঘোজাডাঙা সীমান্ত থেকে মুখ ফেরাচ্ছেন। পরিণামে এখানে রফতানি-ব্যবসা ভাল রকম ধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কা দানা বেঁধেছে।

ঘোজাডাঙা দিয়ে মূলত আট ধরনের পণ্য বাংলাদেশে যায়। মাছ বা ফলের মতো পচনশীল দ্রব্য ছাড়াও হলুদ, শুকনো লঙ্কা, শুকনো কুল, চাল, স্টোন চিপ্স ও স্যান্ড স্টোনও তালিকায় আছে। পণ্য খালাসকারী সংস্থা-সূত্রের খবর: এক-এক রকম পণ্যে ‘তোলা’র হার এক-এক রকম। মোটামুটি তা লরিপিছু ৮০০ থেকে ১৬০০ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করে। মাল খালাস করে ফাঁকা লরি এ-পারে এলেও গুনতে হয় কড়কড়ে তিনশো টাকা! প্রক্রিয়াটা চলছে কী ভাবে?

স্থানীয় সূত্রের খবর: সীমান্তমুখী ফি লরিকে ছ’শো টাকার বিল ধরানো হচ্ছে। ‘কর্মহীন শ্রমিক বাঁচাও কমিটি’র নামে কাটা সেই বিলের নেপথ্যে অবশ্য স্থানীয় কয়েকটি পঞ্চায়েতের একাধিক তৃণমূল সদস্যের ছায়া দেখছেন ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি এক দল লোক ‘পথ নিরাপত্তা’র নামে বিল ছাপিয়ে লরিপিছু ৫০ টাকা তুলছে। বিনিময়ে দিচ্ছে মৌখিক গ্যারান্টি সংগ্রামপুর থেকে ঘোজাডাঙা পর্যন্ত রাস্তায় কেউ লরি ছোঁবে না। অভিযোগ, তৃণমূলের স্থানীয় কিছু নেতার এতে মদত আছে।

সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

এই সাড়ে ছ’শো টাকার বাইরে বাকিটা আদায় হয় রসিদের বালাই ছাড়াই। কী মাল যাচ্ছে, তার উপরে যার অঙ্কটা নির্ভরশীল। ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, প্রধানত সংগ্রামপুরে ইছামতীর সেতু, ঢ্যামঢেমিয়া মোড় ও ইটিন্ডা কলবারির গুবগাব ক্লাবের সামনে লরি আটকে টাকা আদায় হচ্ছে। পণ্য খালাসকারী সংস্থার তরফে বসিরহাট মহকুমা প্রশাসনের কাছে দায়ের করা অভিযোগে বসিরহাট ১ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূল সদস্য রজ্জাক সর্দারের নাম রয়েছে। অভিযোগ, অন্য কিছু তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্যের সঙ্গে মিলে তিনিই ‘সিন্ডিকেট’ চালাচ্ছেন। রজ্জাক কী বলেন?

রজ্জাক সাহেব অবশ্য লরিকে বিল ধরানোয় অন্যায় কিছু দেখছেন না। বরং তাঁর দাবি, শ্রমিকের স্বার্থরক্ষাই তাঁদের উদ্দেশ্য। “আগে সীমান্তের আগে দশচাকার লরি থেকে মাল নামিয়ে ছোট গাড়িতে তুলে ও-পারে নিয়ে যাওয়া হতো। এখন বড় গাড়ি সরাসরি বাংলাদেশে ঢুকে যাচ্ছে। ফলে মাঝপথে মাল ওঠাতেন-নামাতেন যাঁরা, তাঁদের কাজ নেই।” ব্যাখ্যা দিচ্ছেন রজ্জাক। তাঁর বক্তব্য, ওঁদের সাহায্যার্থেই লরিপিছু ছ’শো টাকা নেওয়া হয়, কিছু টাকা ইউনিয়নেরও কাজে লাগে। পুরো ব্যাপারটা প্রশাসন বিলক্ষণ জানে বলে দাবি করে ওঁর পর্যবেক্ষণ, “আগে দশ-বারো জায়গায় চাঁদা নেওয়া হতো। এখন এক জায়গায় টাকা দিয়ে স্লিপ দেখালে অন্য কোথাও দিতে হয় না। এতে লরি-মালিক ও খালাসকারী, দু’পক্ষেরই সুবিধা।”

ব্যবসায়ীরা যদিও এই দাবির সঙ্গে সহমত নন। তাঁদের আক্ষেপ, প্রকারান্তরে জুলুমবাজি-ই চলছে। অথচ প্রশাসন নিস্পৃহ, জেলার মন্ত্রী (খাদ্যমন্ত্রী) তথা তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পর্যবেক্ষক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের সঙ্গে আলোচনাতেও ফল হয়নি। উল্টে মন্ত্রীকে নালিশের পরে অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে গিয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রের খবর। জ্যোতিপ্রিয়বাবুর কী বক্তব্য?

জ্যোতিপ্রিয়বাবু বলেন, “ঘোজাডাঙা সীমান্তে বিভিন্ন ইউনিয়নের নামে লক্ষ লক্ষ টাকা তোলা আদায়ের অভিযোগ পেয়েছি। প্রশাসনকে কড়া ব্যবস্থা নিতে বলেছি।” মন্ত্রীর আরও দাবি, “যারা টাকা তুলছে, তারা মূল তৃণমূলের কেউ নয়।”

শুনে ব্যবসায়ী মহল বিস্মিত তো বটেই, স্থানীয়দের অনেকে অন্য গন্ধও পাচ্ছেন। বিশেষত জ্যোতিপ্রিয়বাবুর দলেরই পঞ্চায়েত সদস্য (রজ্জাক সর্দার) যেখানে বিল ছাপিয়ে চাঁদা তোলার কথা কবুল করছেন, সেখানে মন্ত্রীর এ হেন ‘অজ্ঞতা’ প্রকাশ আরও গুরুতর সংশয়ের জন্ম দিচ্ছে। কর্মহীন যে শ্রমিকদের নামে টাকা তোলা হচ্ছে, তাঁরাও এর পিছনে শাসকদলের কিছু অংশের স্বার্থের আভাস পাচ্ছেন। “স্বয়ং পঞ্চায়েত সদস্য বলেছেন, টাকা তোলা হচ্ছে। অথচ মন্ত্রী জানেন না! সোনার পাথরবাটি!” মন্তব্য এক ভুক্তভোগীর। ওঁদের মতে, সবটাই হল আড়াল করার চেষ্টা। বস্তুত স্থানীয় সূত্রের ইঙ্গিত, সীমান্তে তোলা আদায়ের এই ‘শৃঙ্খল’ শাসকদলের জেলা থেকে রাজ্যস্তর, এমনকী কলকাতায় খাস সদর দফতর পর্যন্ত বিস্তৃত। ঘোজাডাঙায় জুলুমবাজির টাকার বড় অংশ দলের উপরতলার একাংশের হাতে বিলক্ষণ পৌঁছচ্ছে বলে সূত্রটির অভিযোগ।

এমতাবস্থায় বিরোধীরা সোচ্চার। বসিরহাটের সদ্য নির্বাচিত বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের কথায়, “যে দল জামাতের টাকা নিয়ে দল চালায়, তারা লরি থেকে তোলা তুলবে, তাতে আশ্চর্য কী? বাণিজ্য মন্ত্রককে হস্তক্ষেপ করতে অনুরোধ করব।” জেলা কংগ্রেস সভাপতি অসিত মজুমদারের কটাক্ষ, “পুজোর আগে প্রশাসন গা ঝাড়া দিয়েছিল। কিন্তু যেখানে শাসকদলই পৃষ্ঠপোষক, সেখানে তোলাবাজি বন্ধ করে কার সাধ্যি!” স্বভাবতই প্রশাসনের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে। রজ্জাক সর্দার তো বলে দিয়েছেন, প্রশাসনের জ্ঞাতসারে টাকা তোলা হচ্ছে! সত্যিই কি তা-ই?

রজ্জাকের দাবি নস্যাৎ করে জেলার এসপি তন্ময় রায়চৌধুরীর মন্তব্য, “তোলাবাজির অভিযোগ পাইনি।” অভিযোগ পাওয়ামাত্র ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।

তবে আশ্বস্ত হওয়ার মতো কিছু চোখে পড়েনি। ঘোজাডাঙার ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি শুল্ক-কমিশনার নেম সিংহের তথ্য, গত বছর এখান দিয়ে ২ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকার পণ্য রফতানি রয়েছে, আমদানি-শুল্ক মিলেছে ১৩ কোটির। তাঁর মতে, ঘোজাডাঙায় সীমান্ত-বাণিজ্যের আরও সম্ভাবনা রয়েছে। অথচ তোলাবাজির রমরমা সেই সম্ভাবনার আকাশে সিঁদুরে মেঘ ঘনিয়ে তুলেছে। পণ্য খালাসকারীদের অভিযোগ, চাঁদার দৌরাত্ম্যে বহু লরি-মালিক ইদানীং ঘোজাডাঙা সীমান্ত এড়িয়ে চলছেন। খালাসের কারবার মার খাচ্ছে। ওঁদের সংগঠনের সম্পাদক গোলাম মোস্তাফার মন্তব্য, “জেলা প্রশাসনকে জানিয়েছি। নানা ভাবে বাধার সৃষ্টি হলে রফতানিকারীরা সীমান্ত এড়িয়ে চলবেন, এটাই স্বাভাবিক। আশা করব, প্রশাসন বাধা দূর করবে।” শুল্ক-কর্তাও বলেছেন, “স্থানীয় সমস্যার কারণে বাণিজ্য মার খেলে রাজ্য সরকারেরই তা দেখার কথা।”

কথা তো তা-ই। কিন্তু কথা রাখবে কে? সেটাই এখন কোটি টাকার প্রশ্ন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE