Advertisement
E-Paper

অ্যাকাউন্ট ভাড়া দিয়ে ‘ত্রাতা’ সেই সিন্ডিকেট

দাম নেবে চড়া। কিন্তু মাল দেবে খারাপ। অথচ না–নিয়ে উপায়ও নেই। তাদের চোখরাঙানিতে বুক শুকিয়ে যায় না, আমগেরস্তের কলজের অত জোর কোথায়?

শুভাশিস ঘটক

শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:১১

দাম নেবে চড়া। কিন্তু মাল দেবে খারাপ। অথচ না–নিয়ে উপায়ও নেই। তাদের চোখরাঙানিতে বুক শুকিয়ে যায় না, আমগেরস্তের কলজের অত জোর কোথায়?

শহর-শহরতলির মহল্লায় মহল্লায় বাড়ি তৈরির ইট-বালি-সুরকি বেচে গত ক’বছরে যারা ফুলে-ফেঁপে উঠেছে, সেই ইমারতি সিন্ডিকেটের কথা হচ্ছে। এদের বড় অংশের বিরুদ্ধে জুলমবাজির নানা নালিশ। এ-ও শোনা যায়, স্থানীয় নেতাদের কারও কারও হাত মাথায় থাকায় পুলিশ-প্রশাসন ওদের বিশেষ ঘাঁটায় না। এখন শোনা যাচ্ছে, মওকা বুঝে কালো টাকা সাদা করার কারবারেও সিন্ডিকেট কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে!

বস্তুত খোঁজ-খবর নিয়ে জানা যাচ্ছে, অবৈধ তহবিলে বৈধতার ছাপ্পা আদায়ের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক ‘দাদা’ ও প্রোমোটারদের কাছে সিন্ডিকেটই এখন ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ। এমনিতেই বাজারে নগদের অভাবে ইমারতির কাজ-কারবারে মন্দা। এমতাবস্থায় রোজগারের গন্ধ পেয়ে সিন্ডিকেট বিপুল উদ্যমে ঝাঁপিয়েছে নতুন ‘ধান্দা’য়। পুঁজি বলতে নিজেদের ও পরিবারের সদস্যদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। যার ছোঁয়ায় নেতা-প্রোমোটারদের পাঁচশো-হাজারি ‘কালো’ নোটের বান্ডিল বিলকুল সাদা হয়ে যাচ্ছে।

এবং বিনিময়ে মিলছে কমিশন। ব্যাপারটা কী রকম? দক্ষিণ শহরতলির এক প্রোমোটারের অফিসে ঢুঁ মেরে খানিক আন্দাজ পাওয়া গেল। এলাকার তাবড় কিছু প্রোমোটার সেখানে হাজির। কিছু ‘দাদা’র চ্যালা-চামুণ্ডাকেও দেখা গেল। সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ল মোটরবাইকে সওয়ার হয়ে একের পর এক সিন্ডিকেট-মেম্বারের ব্যস্তসমস্ত আনাগোনা। বাতিল পাঁচশো-হাজারের থোক থোক নোট নিয়ে তারা এক এক জন বিদায় হচ্ছে। হাসি ফুটছে অফিসে জমায়েত জনতার মুখে।

কী হচ্ছে? নগদ টাকায় সিন্ডিকেটের পেমেন্ট?

‘‘একেবারেই নয়।’’— বললেন অফিসের এক পিওন। ফিসফিসিয়ে জানালেন, টাকার রং বদলের খেলা চলছে। কিছুক্ষণ বাদে ঢালাও চা-সিঙাড়ার সদ্ব্যবহারের ফাঁকে কয়েক জন প্রোমোটারই ফাঁস করলেন রহস্যটা। জানা গেল, ওঁদের কাছে যে প্রচুর পরিমাণ পাঁচশো-হাজারি নোট রয়ে গিয়েছে (যার বেশিটাই হিসেব বহির্ভূত, অর্থাৎ কালো), সেগুলো নিয়ে সিন্ডিকেটের ছেলেরা নিজেদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা করে দিচ্ছে। বছরভর ব্যবসা করার সুবাদে ওদের একাধিক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে। নিজেদের ট্রেড লাইসেন্সও মজুত। ফলে এক-এক জনের অ্যাকাউন্টে লাখ দুয়েক টাকা অনায়াসে ফেলে দেওয়া যাচ্ছে, যা কিনা আয়কর আওতার বাইরে। উপরন্তু সিন্ডিকেট সদস্যদের কারেন্ট অ্যাকাউন্টেও কয়েক লাখ ঢুকিয়ে দেওয়া যাচ্ছে, বার্ষিক ব্যবসার অঙ্ক অনুযায়ী যার উপরে আয়কর ধার্য হবে। আয়করের টাকাটা সংশ্লিষ্ট ‘দাদা’ বা প্রোমোটারের পকেট থেকেই যাবে।

আর এ ভাবেই এক-এক জন সিন্ডিকেট মেম্বার মারফত আট-দশ লাখ ‘কালো’ টাকার ময়লা অতি সহজে ধুয়ে ফেলা হচ্ছে বলে ইঙ্গিত। প্রোমোটার মহলের খবর: এই ‘সার্ভিস’ বাবদ সিন্ডিকেট চার্জ নিচ্ছে জমা টাকার ২০%। সঙ্গে ক্ষেত্রবিশেষে আয়করের টাকা। সেই কারণে আপাতত জমা টাকার ৪০% রেখে ৬০% জমাকারীকে ফেরত দিচ্ছে সিন্ডিকেট। পরে আয়কর বাদ দিয়ে বাকিটা ফেরানো হবে। ‘‘সোজা কথায়, ওরা ওদের অ্যাকাউন্ট আমাদের কাছে ভাড়ায় খাটাচ্ছে। এই বাজারে ভাড়া যত চড়া-ই হোক না কেন, গুনতে হবে।’’— মন্তব্য এক প্রোমোটারের।

সুতরং চুটিয়ে চলছে টাকার রং বদলের ব্যবসা। সিন্ডিকেট সূত্রের খবর: মেম্বারদের বাড়ির লোকজনের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টও কারবারে বিলক্ষণ খাটছে। এক প্রোমোটারের পর্যবেক্ষণ, ‘‘মনে হচ্ছে, রাজ্য জুড়ে সিন্ডিকেট সদস্য ও তাঁদের পরিজনদের হাজার হাজার অ্যাকাউন্টে কয়েকশো কোটি বাতিল কালো টাকা দিব্যি সাদাহয়ে যাবে।’’

বাস্তবও তা-ই বলছে। রাজারহাট, নিউটাউন, কাশীপুর, ভাঙড়ের অধিকাংশ সিন্ডিকেট সদস্য নিজেদের ও পরিবারের অ্যাকাউন্ট নিয়ে বাজারে নেমে পড়েছে। নির্দিষ্ট ‘দাদা’ ও প্রোমোটারদের সঙ্গে তাদের চুক্তিও সারা। কিন্তু টাকা যদি ফেরত পাওয়া না যায়?

প্রোমোটারদের একাংশের দাবি— এটা পুরোপুরি পারস্পরিক বিশ্বাসের উপরে দাঁড়িয়ে। ধরে নেওয়া যায়, কথার খেলাপ হবে না। তবু নিশ্চিত হতে ওঁরা এক প্রস্ত আলোচনা করেছেন স্থানীয় ‘প্রভাবশালী’ নেতাদের সঙ্গেও, সিন্ডিকেটের ছেলেরা যাঁদের ছত্রচ্ছায়ায়। ‘‘সেখানেও আশ্বাস মিলেছে, টাকা মার যাবে না। আঁটঘাট বেঁধে পুরোটা করা হচ্ছে।’’— প্রত্যয়ী মন্তব্য এক প্রোমোটারের।

নেতারা দেখেও দেখছেন না?

দক্ষিণ শহরতলির শাসকদলের এক প্রভাবশালী নেতার প্রতিক্রিয়া, ‘‘এই ডামাডোলের মওকায় যে যেমন পারছে, ফায়দা লুটছে। আমাদের কোনও স্বার্থ নেই।’’ যদিও সিন্ডিকেটের একাংশ তা মানতে নারাজ। ‘‘নেই আবার! মোদীজির ঘোষণার পরে তো দাদাদের ফোনের অন্ত নেই! যা বোঝার এতেই বুঝে নিন।’’— কটাক্ষ ছুড়লেন রাজারহাটের এক সিন্ডিকেট সদস্য।

‘যা বোঝার’, অনেকেই অবশ্য ইতিমধ্যে বুঝে ফেলেছেন।

Syndicate
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy