Advertisement
১৬ মে ২০২৪
দিদির দলে দাদার কীর্তি

রেপ করিয়ে দেওয়ার হুমকি, তবু চুপ রাজ্য

অনুব্রত মণ্ডল, মনিরুল ইসলামের পরে তাপস পাল। শাসক দলের সংস্কৃতি বজায় রেখে এ বার খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে বিরোধীদের হুমকি দিলেন তৃণমূলের অভিনেতা-সাংসদ। এবং সম্ভবত ছাপিয়ে গেলেন কু-কথার যাবতীয় সীমা-পরিসীমা। বিরোধীদের শুধু গুলি করে মারার হুমকি নয়, তৃণমূলের ছেলেদের দিয়ে তাদের ‘রেপ করিয়ে’ দেওয়ার হুমকিও দিয়ে রেখেছেন তিনি। দাদার এই নয়া কীর্তিতেও এ রাজ্যের পুলিশ অবশ্য সাম্প্রতিক রেওয়াজ মেনে নীরব।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০১৪ ০৩:৪২
Share: Save:

অনুব্রত মণ্ডল, মনিরুল ইসলামের পরে তাপস পাল। শাসক দলের সংস্কৃতি বজায় রেখে এ বার খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে বিরোধীদের হুমকি দিলেন তৃণমূলের অভিনেতা-সাংসদ। এবং সম্ভবত ছাপিয়ে গেলেন কু-কথার যাবতীয় সীমা-পরিসীমা। বিরোধীদের শুধু গুলি করে মারার হুমকি নয়, তৃণমূলের ছেলেদের দিয়ে তাদের ‘রেপ করিয়ে’ দেওয়ার হুমকিও দিয়ে রেখেছেন তিনি। দাদার এই নয়া কীর্তিতেও এ রাজ্যের পুলিশ অবশ্য সাম্প্রতিক রেওয়াজ মেনে নীরব। অনুব্রত, মনিরুলের মতো তাপসকেও গ্রেফতার করার পথে হাঁটেনি তারা। উল্টে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সচিব বলেছেন, “এ ব্যাপারে কেউ তো কোনও অভিযোগ দায়ের করেনি। যদি কেউ এফআইআর করেন, তা হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

কী বলেছেন তাপস?

গত ১৫ জুন নিজের নির্বাচনী কেন্দ্র কৃষ্ণনগরের অন্তর্গত নাকাশিপাড়ার হরনগর গ্রামে নিহত তৃণমূল কর্মী আসাদুল মণ্ডলের স্মরণসভায় যোগ দিতে যান তিনি। ম্যাটাডরে চেপে সেই সভায় আসার পথে দুর্ঘটনায় আহত হন নাকাশিপাড়ার শেষ সীমানা চৌমাহা গ্রামের কয়েক জন তৃণমূল কর্মী-সমর্থক। তাই শুনে স্মরণসভা থেকে সটান চৌমাহা গ্রামে চলে যান তাপস। সেখানে উত্তেজিত ভাবে তিনি বলেন, “আমি প্রচুর মস্তানি করেছি। একটা কেউ বিরোধী যদি মস্তানি করতে আসে, আমাদের ছেলেদের ঢুকিয়ে রেপ করে দেব! এই তাপস পাল ছেড়ে কথা বলবে না। তাপস পাল নিজের রিভলভার বের করে গুলি করে মারবে!”

মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় তোলা তাপস পালের এই বক্তব্য সোমবারই সংবাদমাধ্যমের হাতে এসেছে। আর তার পরেই প্রশ্ন উঠেছে, কেন গ্রেফতার করা হবে না এই তৃণমূল সাংসদকে? কেউ এফআইআর করেননি বলেই পুলিশ ব্যবস্থা নিতে পারছে না, প্রশাসনের কর্তার এমন দাবি উড়িয়ে আইনজীবীরা বলছেন, এ ক্ষেত্রে পুলিশ নিজের থেকেই ব্যবস্থা নিতে পারে। আইন তাকে সেই ক্ষমতা দিয়েছে।

আর বিরোধী রাজনীতিকরা বলছেন, এ সব ক্ষেত্রে পুলিশ গ্রেফতার করবে কি না, তা নির্ভর করে প্রশাসনের নিরপেক্ষতার উপরে। তৃণমূল জমানায় যা অবলুপ্তপ্রায়। শাসক দলের মর্জি মেনেই পুলিশ ওঠাবসা করে বলে প্রকাশ্যে হুমকি দিয়েও অধরা থেকে যান অনুব্রত, মনিরুল, তাপস পালেরা। আত্মসমর্পণ করেই বিনা বাধায় জামিন পেয়ে যান দীপালি সাহার মতো বিধায়ক। দিনের পর দিন ফেরার থাকেন উষারানি মণ্ডল। অন্য দিকে মিথ্যে মামলায় তড়িঘড়ি গ্রেফতার করা হয় বিরোধী দলের বিমল ভাণ্ডারীকে। মাঝরাতে তলবের নোটিস পাঠানো হয় প্রাক্তন মন্ত্রী গৌতম দেবের বাড়ি। কোনও অভিযোগ না থাকা সত্ত্বেও সরকারের বিভিন্ন কাজের সমালোচক নাট্যকর্মী সুমন মুখোপাধ্যায়কে বারবার ডেকে পাঠায় পুলিশ। এক টানা ২৩ ঘণ্টা বসিয়ে রাখে থানায়।

নিরপেক্ষ অবস্থান নিলে তাপসের ক্ষেত্রে কী করা উচিত ছিল পুলিশের?

প্রাক্তন বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, “সাংসদ যা বলেছেন তা প্রকাশ্যে হুমকি দেওয়া এবং আতঙ্ক ছড়ানো। এ ক্ষেত্রে পুলিশ তাঁকে অবিলম্বে গ্রেফতার করতে পারে। দেশের আইনের শাসনকে তিনি যে ভাবে পদদলিত করলেন, তাতে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে গণতন্ত্রের কোনও অর্থ থাকবে না।”

ভগবতীপ্রসাদবাবুর বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন কংগ্রেসের আইনজীবী নেতা অরুণাভ ঘোষ। তিনি বলেন, “কেউ যদি এমন কোনও মন্তব্য বা কাজ করেন যাতে আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তা হলে পুলিশ আইনের ২৩ নম্বর ধারা প্রয়োগ করে তাঁকে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে গ্রেফতার করার অধিকার পুলিশের আছে। এ ক্ষেত্রে ওয়ারেন্ট জারি করারও প্রয়োজন হয় না।”

পুলিশ এবং প্রশাসন কিন্তু এ প্রসঙ্গে নীরব। তাপস-কাণ্ড নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র। স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়ও মন্তব্য এড়িয়ে গিয়েছেন। রাজ্য পুলিশের ডিজি জি এম পি রেড্ডিকে ফোনে পাওয়া যায়নি। এসএমএস করা হলেও জবাব দেননি তিনি।

তাপসের দল তৃণমূল কী বলছে?

তৃণমূলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েনের জবাব, “এই রকম অসংবেদনশীল মন্তব্য আমাদের দল কখনওই অনুমোদন করে না। স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের নীতি অনুযায়ী যে কোনও ব্যক্তিকেই আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সাংসদকেও লিখিত ভাবে জবাবদিহি করতে হবে। এর বেশি কিছু বলতে পারব না।” তৃণমূল সূত্রে বলা হয়েছে, কাল, বুধবার দলের সাংসদদের জন্য ডাকা পূর্বনির্ধারিত বৈঠকেই তাপসের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

কিন্তু তাপসকে গ্রেফতারের প্রশ্নে শাসক দল নীরবই। উল্টে দলের আইনজীবী সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “এই ধরনের বক্তব্য আমি সমর্থন করি না। তবে মেঠো বক্তৃতায় এই ধরনের কথা বললে তা আইনের চোখে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে কি না, সে ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত রায় এখনও আসেনি। পাড়ুই মামলার (যাতে অভিযুক্ত তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল) ক্ষেত্রে অনুরূপ অভিযোগ এখনও সর্বোচ্চ আদালতের বিচারাধীন।” তাপসের দুই মহিলা সহকর্মী, সাংসদ শতাব্দী রায় ও কাকলি ঘোষদস্তিদারের প্রতিক্রিয়া বহু চেষ্টা করেও জানা যায়নি। গভীর রাত পর্যন্ত তাঁদের ফোন বেজে গিয়েছে।

বিরোধী রাজনীতিকরা অবশ্য তাপসের গ্রেফতারই দাবি করছেন। সেই সঙ্গে উঠছে সাংসদ পদ থেকে তাঁর ইস্তফার দাবিও। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, এমন কুরুচিকর কথা বলার পরে তাপসের আর জনপ্রতিনিধি থাকার নৈতিক অধিকারই নেই! তৃণমূল নেতাদের মুখে এমন কথা স্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেও বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের দাবি, সাংসদ থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন তাপস। আর তৃণমূলেরও উচিত অবিলম্বে ওঁকে সাংসদ পদ থেকে সরানো।

তাপসের মুখে এ ধরনের বেলাগাম মন্তব্য অবশ্য নতুন নয়। ২০০৯ সালে প্রথম বার সাংসদ হওয়ার পরেই অগস্ট মাসে নাকাশিপাড়াতেই এক ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে তৎকালীন শাসক দলের বিরুদ্ধে তিনি বলেন, “যারা ধর্ষণ করেছে, তাদের হাতের কাছে পেলে পিটিয়ে মেরে ফেলুন। আমি তাপস পাল বলছি।”

তার পর গত বছর জুলাই মাসে তেহট্টে পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারে গিয়ে তাঁর মন্তব্য, “সিপিএম বদমাইশের দল, শয়তানের দল, জঘন্য দল। এদের জুতিয়ে সোজা করে দিতে হবে। যেখানে সিপিএম-কে দেখবেন, ধরে কেলানি দেবেন।”

এবং এ দিনও তাপস বাহ্যত নির্বিকারই। তাঁর দাবি, “ভোটের পর থেকে ওখানে সিপিএম আমাদের কর্মীদের উপরে অত্যাচার করছে। সেই সব দেখেই মাথা গরম করে ও’কথা বলে ফেলেছি।”

কিন্তু ঘটনা হল, চৌমাহা গ্রামে ইদানীং সিপিএমের হাতে তৃণমূলের লোকেদের আক্রান্ত হওয়ার খবর নেই। পঞ্চায়েতটি নিরঙ্কুশ ভাবে তৃণমূলেরই দখলে। সিপিএম ও তৃণমূলের মধ্যে মাঝেসাঝে ছোটখাটো গোলমাল হয়। লোকসভা ভোটের দিন এই গ্রামের বুথে তৃণমূলের ভোটারদের আটকানোর অভিযোগকে ঘিরে উত্তেজনা ছড়িয়েছিল। সেই সময় তাপস নিজে গ্রামে এসে কিছু ‘কটু মন্তব্য’ শুনে মাথা গরম করেছিলেন। পুলিশের সঙ্গেও বাক্-বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। পুরনো সেই অভিজ্ঞতার রেশ সম্ভবত রয়ে গিয়েছিল মনে।

কিন্তু ‘রেপ করানোর’ মতো চূড়ান্ত অশালীন কথা তিনি বললেন কী করে? বৈদ্যুতিন মাধ্যমে তাপসের দাবি, তিনি ‘রেপ’ নয়, ‘রেড (raid) করার’ কথা বলেছিলেন! যদিও ফুটেজে তাঁকে ‘রেপ করিয়ে’ দেওয়ার কথাই বলতে শোনা গিয়েছে এবং তাতে প্রবল হাততালির শব্দও পাওয়া গিয়েছে!

তাপস সে দিন আরও বলেছেন, “আমি চন্দননগরের মাল। কলকাতার মাল নই।... সিপিএম কোনও কর্মীর গায়ে হাত দিলে আমি তোলপাড় করে ছেড়ে দেব। আমিও তাপস পাল। মাল নিয়ে ঘুরে বেড়াই। মাল মানে মাল! মা-বোনেদের গায়ে হাত দিলে গুলি করব!” তাপসের এই মন্তব্যের ফুটেজ প্রকাশের পরেই সে প্রসঙ্গ উল্লেখ না করলেও তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে তাঁর সহধর্মিণী নন্দিনী পাল ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমি নীরবে কেঁদেছি। নিজের মধ্যে কেঁদেছি। কোনও আশা নেই জেনেই কেঁদেছি।’

সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন...

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

tapas pal tmc hate speech
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE