ট্যাক্সি তো অনড়ই। এ বার বাসমালিকরাও অন্য বারের তুলনায় কঠোর মনোভাব দেখানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন। রবিবারের বৈঠকে তৃণমূল নেতৃত্বকে সে কথা বুঝিয়েও দিয়েছেন তাঁরা। শেষ পর্যন্ত তিন দিনের টানা ধর্মঘটে যদি তাঁরা অনড় থাকেন, তা হলে সপ্তাহভর যাত্রাপথে নাকানিচোবানি খেতে হবে কলকাতাকে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিঙ্গাপুর সফরকালে ট্যাক্সিচালক ও বাস-মালিকদের আন্দোলন নিয়ে শাসকদল বিব্রত। লগ্নি আকর্ষণের লক্ষ্যে মুখ্যমন্ত্রী যখন বিদেশে যাচ্ছেন, তখনই পরিবহণক্ষেত্রে টালমাটাল শিল্পমহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে বলে তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশের আশঙ্কা। তাই ভাড়াবৃদ্ধির দাবিতে বুধবার থেকে ৭২ ঘণ্টা ধর্মঘটের ডাক দেওয়া বাস-মালিক সংগঠনগুলির সঙ্গে রবিবার বৈঠকে বসেছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়, ধর্মঘট তোলার অনুরোধ নিয়ে। বিকেলে ও রাতে দু’দফায় তিনি তৃণমূল ভবনে বাস-মালিকদের সঙ্গে কথা বলেন। বৈঠকের প্রাপ্তি তেমন কিছু নয়। ভাড়াবৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করলেও আশু ভাড়াবৃদ্ধির আশ্বাস তিনি মালিকদের দিতে পারেননি। তাই ধর্মঘট থেকে সরার নিশ্চয়তাও বাস-মালিকেরা মুকুলবাবুকে দেননি। শুধু জানান, আজ, সোমবার তাঁরা নিজেদের বৈঠকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।
এ দিনের বৈঠকের ফলা সম্পর্কে কোনও পক্ষই বিশদে মুখ খোলেনি। মিনিবাস মালিকদের তরফে অবশেষ দাঁ’র কথায়, “বাসভাড়া নিয়ে কথা হয়েছে। তবে বলার মতো সিদ্ধান্ত হয়নি। হলে জানাব।” সংগঠন-সূত্রের খবর: সরকারকে চাপে রাখতে বাস-মালিকদের একটা বড় অংশ ধর্মঘটের সিদ্ধান্তে অটল থাকার পক্ষপাতী। এ প্রসঙ্গে তাঁরা ট্যাক্সিচালকদের আন্দোলনকে দৃষ্টান্ত খাড়া করছেন।
‘প্রশাসনিক জুলুমের’ প্রতিবাদে ট্যাক্সিচালকেরা আন্দোলনে অনড়। সিটু, এআইটিইউসি, আইএনটিইউসি-সহ বেশ ক’টি বিরোধী শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্বে আজ, সোমবার দুপুর দু’টোয় ধর্মতলায় ওয়াই চ্যানেলে তাঁরা সমাবেশ করবেন, যেখানে ঘোষিত হবে পরবর্তী কর্মসূচি। বাস-মালিকেরা তাঁদের ধর্মঘটে সামিল হতে ট্যাক্সিকে আহ্বান জানিয়েছেন। ইউনিয়নের এক সূত্রের ইঙ্গিত, ট্যাক্সিচালকেরা এই মুহূর্তে তেমন কিছু ভাবছেন না।
তাই বলে অবশ্য সপ্তাহের প্রথম দিনে আম-যাত্রীর পথ-দুর্ভোগের আশঙ্কা কাটছে না। কেননা ইউনিয়ন-সূত্রেরই খবর, সমাবেশে যোগদানের কারণে অধিকাংশ ট্যাক্সিচালক আজ গাড়ি বার করবেন না। “ট্যাক্সিচালকেরা ধর্মঘট করছেন না। কিন্তু সোমবার তাঁরা সমাবেশে যোগ দিতে আসবেন। সে জন্য চালকেরা সোমবার গাড়ি বার করবেন কি না, সেটা তাঁরাই বলতে পারবেন।” এ দিন মন্তব্য করেছেন সিটু নেতা সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
পরিণামে সোমবার সকাল থেকে ফের কলকাতা ট্যাক্সিহীন হয়ে পড়ার প্রভূত সম্ভাবনা। জরিমানায় রাশ ও ধৃত সতীর্থদের মুক্তির দাবিতে গত সপ্তাহ জুড়ে ট্যাক্সিচালকেরা যে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ করেছেন, মহানগরের গণ পরিবহণে তার প্রভাব ভাল রকম মালুম হয়েছে। পথের ভোগান্তি টের পেয়েছেন মানুষ। আন্দোলনকারীরাও পেয়েছেন প্রাথমিক সাফল্যের স্বাদ। আদালতে সরকারপক্ষের বিনা আপত্তিতে ধৃতদের জামিন মঞ্জুর হয়। পরে সরকার ফের কড়া অবস্থান নিয়েছে। প্রতিবাদে ফের আন্দোলনে নেমেছেন ট্যাক্সিচালকেরা।
কিন্তু ট্যাক্সি-আন্দোলনের প্রাথমিক সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়েই ধর্মঘট করে সরকারের উপরে চাপ বাড়াতে আগ্রহী বাস-মিনিবাস মালিকদের বড় অংশ। ওঁদের মতে, ট্যাক্সির আন্দোলন দেখিয়েছে, দাবি আদায়ের অন্যতম পূর্ব শর্ত হল একজোট হওয়া ও অনমনীয় থাকা। এ দিন মুকুলবাবু সঙ্গে বৈঠকের পরেও ওঁদের ওই মনোভাব বজায় আছে। মালিক-সূত্রের খবর: গত ৯ অগস্ট মুকুলবাবু বাস-মালিক সংগঠনের তৃণমূলপন্থী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। তিনি এ-ও আশ্বাস দিয়েছিলেন, বিষয়টি তিনি মুখ্যমন্ত্রীর গোচরে আনবেন। মালিক-সূত্রের দাবি, বাসের ভাড়া বাড়ানো যে দরকার, মুকুলবাবু বৈঠকে তা মেনেছেন। কিন্তু ভাড়াবৃদ্ধি সম্পর্কে ইতিবাচক কোনও কথা মালিকদের শোনাতে পারেননি।
তাই বাস-মালিকদের অনেকেই চাইছেন না নরম হতে। ওঁদের অভিযোগ: সস্তার রাজনীতির খেসারত দিচ্ছে পরিবহণ শিল্প। দফতরের বিশেষ কমিটি ভাড়াবৃদ্ধির পক্ষে রায় দিয়েছে। এমনকী, বিধায়ক-মন্ত্রীদের নিয়ে তৈরি সরকারি কমিটিও ভাড়াবৃদ্ধির যৌক্তিকতা মেনে মুখ্যমন্ত্রীকে রিপোর্ট দিয়েছে। তবু জনপ্রিয়তা খোয়ানোর আশঙ্কায় মুখ্যমন্ত্রী অনড়। “পরিবহণ শিল্প তো লাটে ওঠার জোগাড়! তবু মুখ্যমন্ত্রী রাজনীতির অঙ্ক কষে যাচ্ছেন! আমরা বারবার ধর্মঘট ডেকেও সরকারের নানা অজুহাতে তুলে নিচ্ছি!” আক্ষেপ করছেন এক বাস-মালিক। তাঁর বক্তব্য, “এ বারেও ধর্মঘট না করলে আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে ঠেকবে।”
এমতাবস্থায় ২০ অগস্ট থেকে বাহাত্তর ঘণ্টা ধর্মঘটের জোরদার প্রস্তুতি শুরু করেছে বাস-মিনিবাস মালিকদের বিভিন্ন সংগঠন। বেসরকারি অন্যান্য পরিবহণ মাধ্যমকেও আহ্বান জানানো হয়েছে। এ নিয়ে লাক্সারি ট্যাক্সি সংগঠনের তরফে আজ বা কাল সিদ্ধান্ত ঘোষণার সম্ভাবনা। সাধারণ ট্যাক্সি ও অটোর সঙ্গে কথা শুরু হয়েছে। “আমরাও এ বার সুর চড়াব। যাতে সরকার একটা কিছু সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বাধ্য হয়।” বলছেন বাস-মালিক সংগঠনের এক নেতা।
আর এই টানাপোড়েনের জেরে দৈনন্দিন যাত্রাপথে দুর্দশার ফাঁস ক্রমশ চেপে বসছে আম নাগরিকের গলায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy