এই সেই বাস। —ফাইল চিত্র।
টেট-এর প্রশ্নপত্র হারানোয় সরকারি কর্মীদের বিরুদ্ধেই বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ করেছিল মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। সেই তত্ত্বে মান্যতা দিয়ে তড়িঘড়ি সিআইডিকে তদন্তভার সঁপেছিল শিক্ষা দফতর। মাত্র ১৮ দিনেই সেই তদন্তে প্রথম পর্যায়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সিআইডি। বৃহস্পতিবার তারা জানিয়েছে, বিশ্বাসঘাতকতা বা ষড়যন্ত্র নয়, নেহাতই দুর্ঘটনাবশত প্রশ্নগুলি হারিয়ে গিয়েছে।
সিআইডির দাবি, টেট-এর প্রশ্নপত্র বোঝাই বাস থেকে দুর্ঘটনাবশত একটি প্রশ্নপত্রের প্যাকেট পড়ে গিয়েছিল। এক লরিচালক ও খালাসি সেটি কুড়িয়ে পান এবং ভেতরে শুধু কাগজপত্র রয়েছে দেখে বন্দর এলাকার নর্দমায় ফেলে দেন। নর্দমা থেকে প্রশ্নপত্রের কোনও হদিস অবশ্য মেলেনি। এ দিন ভবানী ভবনে সিআইডি আইজি (২) বিনীত গোয়েল বলেন, ‘‘বাসের ফাইবার গ্লাস খুলে প্রশ্নপত্র পড়ে গিয়েছিল। পরে অন্য একটি লরির চালক সেটি নষ্ট করে ফেলেন। এটি নেহাতই দুর্ঘটনা। এখনও এর সঙ্গে অপরাধের কোনও যোগ মেলেনি।’’
গত ২৭ অগস্ট মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অফিস থেকে প্রশ্নপত্র বোঝাই একটি বাস রওনা দিয়েছিল। সেই বাস থেকে এক প্যাকেট প্রশ্নপত্র খোয়া যায়। দেখা যায়, ওই বাসের পিছনের ফাইবার গ্লাসটিও ভাঙা। এর পরেই বিষয়টি নিয়ে হইচই হয়। ষড়যন্ত্র করেই ওই প্রশ্নপত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে কি না, সে প্রশ্নও উঠেছিল। যাকে আরও জোরালো করেছিলেন টেট-এর দায়িত্বে থাকা মধ্যশিক্ষা পর্ষদের প্রশাসক কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি পুলিশে এই ঘটনায় বাসে থাকা ডাক বিভাগের দুই কর্মী এবং দুই পুলিশকর্মীর বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ এনেছিলেন। পরে প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছিল, প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগের ওই পরীক্ষা ঘিরে ‘অসাধু চক্র’ সক্রিয়। যে বিজ্ঞপ্তির পরে ফের নতুন ভাবে মাথাচাড়া দিয়েছিল প্রশ্ন উধাও কাণ্ড। এ দিন অবশ্য কল্যাণময়বাবু মুখ খুলতে চাননি।
এত কিছুর পরেও সিআইডি এই ঘটনাকে নিছক দুর্ঘটনা বলে কী ভাবে?
সিআইডি কর্তাদের দাবি, এই তদন্তে নেমে প্রশ্নপত্র বয়ে নিয়ে যাওয়া বাসের চালক স্বপন বসু ও খালাসি উজ্জ্বল কুণ্ডুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। তাঁরা জানান, মাইতিপাড়ার কাছে যানজটে দাঁড়ালে এক লরিচালক তাঁদের জানান, বাসের পিছনের ফাইবার গ্লাস খোলা। তখন পুলিশ ও ডাক কর্মীরা প্রশ্নপত্রের প্যাকেট মেলাতে গিয়ে দেখেন, মধ্যশিক্ষা পর্ষদ থেকে ১৫৪ প্যাকেট তোলা হয়েছিল। কিন্তু তখন রয়েছে ১৫৩টি। অর্থাৎ একটি প্যাকেট কম। এর পরেই বাস ঘুরিয়ে ফের মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অফিসে ফিরে আসেন তাঁরা। রাতেই ডাক বিভাগ নিশ্চিন্দা থানায় প্রশ্নপত্র চুরির অভিযোগ দায়ের করে। একই বয়ান মেলে বাসে থাকা দুই ডাক ও দুই পুলিশকর্মীর কাছ থেকেও।
গোয়েন্দা সূত্রের খবর, চালক, খালাসি এবং বাকি চার সরকারি কর্মীর বয়ান মিলিয়ে দেখার জন্য নিবেদিতা সেতুর টোল প্লাজার সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখা হয়। ২৭ অগস্ট বেলা ১১টা ৮ মিনিটে বাসটি টোলপ্লাজা দিয়ে গিয়েছিল। তার পাঁচ মিনিট আগে-পরে টোলপ্লাজা দিয়ে যাতায়াত করা সব গাড়ির নম্বর পরীক্ষা করা হয়েছিল। তদন্তকারীরা বলছেন, ওই সময়ের মধ্যে প্রায় ১০০টি গাড়ি গিয়েছিল। তার মধ্যে ছিল পাণ্ডুয়ার আব্দুল কাসেমের টাটা সুমোও। কাসেম গোয়েন্দাদের জানান, মাইতিপাড়ার বেশ কিছুটা আগে বাস থেকে কিছু একটা পড়়ে যেতে দেখেছিলেন তিনি। দেখেছিলেন, পিছনে থাকা একটি লরির খালাসি সেটি কুড়িয়ে নিচ্ছেন। এর পরে ওই লরিটিকে চিহ্নিত করে তার চালককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
গোয়েন্দারা বলছেন, ওই লরিটি কাশীপুর এলাকার। সেটি ফুড কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া (এফসিআই)-র ভাড়া খাটে। লরির চালক তরুণ ভুঁইয়া তদন্তকারীদের জানান, তাঁর খালাসি প্যাকেটটি দামি মনে করে কুড়িয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু পরে শুধুই কাগজপত্র রয়েছে দেখে তারাতলার হাইড রোডে এফসিআই গুদামের আগে নর্দমায় ফেলে দেন। তবে খালাসিকে পাওয়া যায়নি। তিনি বিহারে দেশের বাড়ি চলে গিয়েছেন। তবে এক গোয়েন্দাকর্তা বলেন, ‘‘ওঁরা যে নর্দমায় প্যাকেটটি ফেলছেন, তা নজর করেছিলেন গুদামের বাইরে থাকা বেশ কয়েক জন। আমরা তাঁদের সঙ্গেও কথা বলেছি।’’
এ দিনও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠানো হয়েছিল তরুণ ও তাঁর গাড়ির মালিককে। পরে ভবানী ভবন চত্বরে দাঁড়িয়ে তরুণ বলেন, ‘‘আমি ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়েছি। প্যাকেটের মধ্যে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র রয়েছে, তা বুঝতে পারিনি।’’
প্রশ্ন উঠেছে, বাসের ফাইবার গ্লাস খুলে পড়ে গেল কী ভাবে? কেন-ই বা বাসের চালক, খালাসি বা সরকারি কর্মীরা তা খেয়াল করলেন না?
পুলিশের ব্যাখ্যা, বাসের পিছনের সিটে প্রশ্নপত্রগুলি ডাঁই করে রাখা হয়েছিল। প্রায় ছাদ পর্যন্ত ঠেকে গিয়েছিল প্যাকেটগুলো। বাসের ফাইবার গ্লাসটিও নড়বড়ে ছিল। তাই বাস চলার সময় ঝাঁকুনিতে ফাইবার গ্লাস আলগা হয়ে একটি প্যাকেট গলে পড়ে যায়। গাড়ির গতি বেশি থাকায় চট করে তা বুঝতে পারেননি চালক। তবে পুলিশের একাংশ বলছেন, যে ভাবে বাসে প্রশ্নপত্র রাখা হয়েছিল, তাতে ডাক ও পুলিশকর্মীদের বিরুদ্ধে কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগ আনাই যায়। এই অভিযোগে দুই ডাক কর্মীকে ইতিমধ্যেই সাসপেন্ড করা হয়েছে। ডাক বিভাগের তরফ থেকে আগে দাবি করা হয়েছিল যে, প্রশ্নপত্রের ১৫৪টি প্যাকেট ওই বাসে তোলা হয়নি। সেই দাবি নাকচ করে সিআইডি জানিয়েছে, পর্ষদে লাগানো সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গিয়েছে প্রতিটি প্যাকেটই বাসে তোলা হয়েছিল।
সিআইডি কর্তারা বলছেন, বাসের দুই পুলিশকর্মী হুগলি জেলায় কর্মরত। তাঁদের কর্তব্যে গাফিলতি রয়েছে কি না, তা হুগলি জেলা পুলিশই বলতে পারবে। যদিও হুগলি জেলা পুলিশের কর্তারা বলছেন, সিআইডি যদি কিছু জানায় তবেই তাঁরা ব্যবস্থা নেবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy