ফাইল চিত্র।
যে মেয়ের বাবা নেই এবং যে মেয়ে জানে, পড়াশোনা করে তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে, গত দেড়টা বছর তার কী ভাবে কাটতে পারে, সেটা শুধু সে-ই জানে।
আমার মা অবশ্য বলেন, কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে গেলে তবেই জীবনের শিক্ষা পাওয়া যায়। সেই পাহাড়ই আমরা ডিঙোলাম এই সময়টায়। আমি নবম শ্রেণিতে পড়ি। আমার দিদি পড়ে একাদশে। আর সঙ্গে আছেন আমাদের মা ইন্দ্রকলা, যিনি এই সময়টায় দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইটা চালিয়ে গিয়েছেন।
আমার বাবা নীরজকুমার দাহাল যখন মারা যান, তখনও করোনা শব্দটা আমাদের পরিচিত ছিল না। বাবা বিএসএফের কাজ করতেন। কিডনির অসুখে ভুগছিলেন। তিনি যে হঠাৎ মারা যাবেন, ভাবতে পারিনি। সেটা ২০১৯ সাল। আমার তখন বয়স আরও কম। তবে এটুকু বুঝতে পারছিলাম, বাবা চলে যাওয়ায় আমাদের জীবনে বড় পরীক্ষার মুখে পড়তে হল। আর্থিক সম্বল বলতে বাবার নামে পারিবারিক পেনশনটুকু। মা গৃহবধূ। তিনি আমাদের দুই বোনকে পালন করছিলেন। এ বারে একেবারে পাশে এসে দাঁড়ালেন একাই বাবা ও মায়ের জায়গা নিয়ে।
তখন আমাদের একমাত্র লক্ষ্য, কী ভাবে পড়াশোনাটা ভাল ভাবে চালিয়ে যাব। আমরা থাকি কালিম্পং শহরতলিতে। কালিম্পঙেরই সেন্ট ফিলোমেনাস গার্লস হাই স্কুলের ছাত্রী আমি। তখনও ভাবতে পারিনি, এই পড়াশোনার পথেও কত বড় বাধা অপেক্ষা করে আছে। বুঝলাম, যখন ২০২০ সালের মার্চের শেষ দিকে বন্ধ হয়ে গেল স্কুল। আমাদের মতো ঘরে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়াশোনা করা আর্থিক ভাবেই সম্ভব নয়। তাই স্কুলের শিক্ষকদের উপরেই নির্ভর করতাম আমরা দুই বোন। সেই পড়া বন্ধ হয়ে গেল আমাদের। প্রথম দু’মাস তো বুঝেই উঠতে পারছিলাম না, কী হবে। পুরো লকডাউন তখন। তার পর খুব ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হতে শুরু করল। স্কুল থেকেও অনলাইনে পড়ানোর ব্যবস্থা করা হল।
আমাদের ক্লাসের জন্য আলাদা করে স্মার্টফোন কেনার সামর্থ্য নেই। তাই বাবার ফোনটাই হল আমাদের ক্লাসঘর। সেটাই কখনও আমি, কখনও দিদি ব্যবহার করতে শুরু করলাম। খুব অসুবিধা হত। তার উপরে আবার আমাদের এখানে ইন্টারনেটের হাল খুব খারাপ। কী ভাবে যে দেড়টা বছর পড়াশোনা করেছি, আমরাই জানি। দিদি অবশ্য আমাকে কিছু কিছু সাহায্য করেছে। কিন্তু তাতেই কি সব হয়? স্কুল চালু থাকলে ক্লাসের বাইরেও শিক্ষকদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় পড়া বুঝে নিতে পারতাম। বাড়ি থেকে লিখে নিয়ে গিয়ে দেখাতে পারতাম। নবম আর দশম শ্রেণি আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। স্কুল থেকে এই বাড়তি সাহায্য না পেলে আমাদের মতো সাধারণ ঘরের পড়ুয়াদের চলবে কী করে?
স্কুল খোলার খবরটা যেন তাই আশীর্বাদের মতো এসেছে। কত দিন বাদে ক্লাসঘরে গিয়ে বসব, প্রিয় দিদিমণিদের সঙ্গে দেখা হবে। কত দিন পরে বন্ধুদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ি পথে গায়ে নভেম্বরের রোদ মেখে বাড়ি ফিরতে পারব। এই পথটা তো হেঁটেই যেতে হয় আমাদের। গাড়ি ভাড়া আর কোথায় পাব!
বাবার স্মার্টফোনটা এত দিন পুরো দিন অনলাইন ক্লাসে ব্যস্ত থাকত। সেটা এ বারে একলা হয়ে যাবে। ঠিক মায়ের মতো।
(লেখক সেন্ট ফিলোমেনাস গার্লস হাই স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy