আতঙ্কে চোখে জল পুলিশের। ছবি এবিপি আনন্দের সৌজন্যে।
স্কুল চত্বরের বৈঠকে চলছিল বর্ণনা— কী ভাবে পুলিশ ‘মেরেছে’ পড়ুয়া-শিক্ষকদের। কার পিঠে, কার কোমরে পড়েছে লাঠির বাড়ি। বর্ণনার পাট চুকতেই বৈঠক-মঞ্চ থেকে এল আবেদন—‘আসুন আমরা সই সংগ্রহ করি। অন্তত ১০ হাজার লোকের সই সংগ্রহ হয়ে গেলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পুলিশের বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাব’। কিন্তু আউশগ্রাম হাইস্কুলের শিক্ষক, পরিচালন সমিতির সদস্য, অভিভাবকেরা যখন এই আবেদনের পথে হাঁটার কথা বলছেন, স্কুল চত্বর ছেড়ে কিছু লোক হাঁটা লাগিয়েছে থানার দিকে। তাদের মুখে একটাই কথা— ‘‘থানায় চল। দেখছি।’’
স্কুল গেটের পাশে নিকাশির জায়গা দখলকে কেন্দ্র করে শুক্রবার জনতা-পুলিশ খণ্ডযুদ্ধের পর থেকেই তেতে ছিল আউশগ্রাম। শনিবার বেলা ১১টা নাগাদ কাজে আউশগ্রামে গিয়ে শুনি, হাইস্কুল চত্বরে বৈঠক হচ্ছে। কৌতূহলের বশে ঢুকে পড়েছিলাম। সেখানে তখন শ’পাঁচেক লোক। তাদের মধ্যেই এক দল ঢিল ছোড়া দূরত্বে থানার দিকে হাঁটা লাগাতে এগোই সে দিকে। স্কুল কর্তৃপক্ষ তখন বারবার বলছেন, ‘‘প্রতিহিংসার রাস্তায় যাবেন না। আমরা কোনও অশান্তি চাই না। সবাই বাড়ি চলে যান।’’ ভিড়ের একটা বড় অংশ অবশ্য সে কথায় কান না দিয়ে স্কুল ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছে। তাদের খোঁজে গিয়ে দেখি, অন্তত শ’তিনেক লোক জমা হয়ে গিয়েছে থানার সামনে। কারও হাতে লাঠি, কেউ নিয়েছে গাছের ভাঙা ডাল, কারও হাতে আধলা ইট।
চোখের পলক ফেলার আগেই কিছু লোক আউশগ্রাম থানার নাম লেখা বোর্ডে দমাদ্দম ইট মারতে থাকে। ভেঙে ফেলে থানার সামনের বাঁশের বেড়া। উল্টে ফেলা হয় মহিলাদের সহায়তার জন্য গড়া হেল্প-ডেস্ক-এর টেবিল। পুলিশের গাড়িতে তখন বৃষ্টির মতো ইট-পাথর পড়ছে। ঝনঝনিয়ে ভাঙছে কাচ। লাথি মেরে ফেলে দেওয়া হয় থানায় দাঁড় করানো মোটরবাইকগুলো। সে ধুন্ধুমারের ছবি তুলতে যেতেই বাধল বিপত্তি!
১০-১২ জনের একটা দল আমার দিকে তেড়ে এল। হাতে লাঠি। প্রত্যেকের মুখ গামছা, মাফলারে ঢাকা। তবে গলার স্বরে বুঝতে অসুবিধা হয়নি ওদের বয়স ২৫-৩৫ বছরের মধ্যে। কার কারও মুখ থেকে মদের গন্ধ বেরোচ্ছে। ওদের মধ্যে নেতা গোছের এক জন হুকুমের স্বরে বলে, ‘‘যা ছবি তুলেছিস, মুছে ফেল!’’ কয়েকজন বলতে শুরু করে, ‘‘ওর মোবাইলটা কেড়ে নে!’’ দু’-এক জন সে চেষ্টা শুরুও করে।
টানাটানি, ধাক্কাধাক্কি করতে করতে দলটা আমাকে এনে ফেলে থানার গেটের বাইরে। পিঠে, ডান পায়ে বাড়ি পড়ে লাঠির। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেছি দেখেই বোধ হয়, থানার সামনে দাঁড়ানো কয়েকজন দৌড়ে আসেন আমাকে বাঁচাতে। হামলাকারীরা তাঁদেরও রেয়াত করেনি। এক জনের পায়ে প্রচণ্ড জোরে লাঠির বাড়ি মারে ওরা। তবে ততক্ষণে এলাকার আরও কিছু লোক এসে পড়ে আমাদের সাহায্যে। মিনিট পাঁচেক প্রবল টানাহেঁচড়ার পরে আমাকে সেখান থেকে সরিয়ে স্কুলের ভিতরে পৌঁছে দেন কয়েকজন।
সাহায্যে এগিয়ে আসে অনেক হাত। পিঠ-পায়ের চোটে ওষুধ লাগানোই হোক বা জলের গ্লাস এগিয়ে দেওয়া—সমবেদনার অভাব ছিল না এতটুকু। কয়েক জন বলছিলেন, ‘‘দেখুন তো কাণ্ড! বিনা কারণে কেউ মানুষকে এমন ভাবে মারে!’’ তখনও ধাতস্থ হইনি। ভাবছি, ‘‘চোখের পলকে জনতা কতটা হিংস্র হয়ে উঠতে পারে, বড্ড কাছ থেকে দেখা হয়ে গেল!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy