Advertisement
E-Paper

কবরখানার মাটিও খেয়ে নিচ্ছে ভাঙন

জলবায়ু বদল ও সাগর পাড়ের বিভিন্ন দ্বীপের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের প্রতীক— নামখানা ব্লকের মৌসুনি দ্বীপ। সরকারি হিসেবে ভাঙনের গ্রাসে ইতিমধ্যেই প্রচুর বাড়ি, গবাদি পশু, সম্পত্তি নষ্ট হয়েছে। নোনা জল ঢুকে নষ্ট করে দিয়েছে খেতের ফসল, পুকুরের মাছ।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৩:৩৮
আসন্ন-বিপদ: এ ভাবেই ভাঙনের গ্রাসে চলে যাচ্ছে মৌসুনি দ্বীপ।—নিজস্ব চিত্র।

আসন্ন-বিপদ: এ ভাবেই ভাঙনের গ্রাসে চলে যাচ্ছে মৌসুনি দ্বীপ।—নিজস্ব চিত্র।

আট বছর আগে মে মাসের দুপুরে আচমকা হাজির হয়েছিল এক বিপদ। আজও সে পিছু ছাড়েনি দক্ষিণ ২৪ পরগনার মৌসুনি দ্বীপের বাসিন্দাদের। প্রতিদিনই সেই বিপদ একটু একটু করে গিলে খাচ্ছে কয়েক হাজার বাসিন্দাকে!

জলবায়ু বদল ও সাগর পাড়ের বিভিন্ন দ্বীপের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের প্রতীক— নামখানা ব্লকের মৌসুনি দ্বীপ। সরকারি হিসেবে ভাঙনের গ্রাসে ইতিমধ্যেই প্রচুর বাড়ি, গবাদি পশু, সম্পত্তি নষ্ট হয়েছে। নোনা জল ঢুকে নষ্ট করে দিয়েছে খেতের ফসল, পুকুরের মাছ। নোনা জলের দাপটে বড় বড় গাছও মৃতপ্রায় হয়ে গিয়েছে। জীবিকার টানে সাগরতীরবর্তী ওই দ্বীপের প্রচুর পুরুষ পাড়ি দিয়েছেন ভিন্‌ রাজ্যে। ভাঙনের ভয় এমন যে, স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোনও সরকারি চিকিৎসক থাকতে চান না। গ্রামের এক যুবক ডাক্তারি পাশ করে মৌসুনির প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চাকরি পেয়েছিলেন। তিনিও থাকতে চাননি।

মৌসুনি দ্বীপের বালিয়াড়া গ্রামে ভাঙা বাঁধের কাছে দাঁড়িয়েই কথা বলছিলেন স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য হিমাংশু আইচ। জানালেন, ক্রমশ পা়ড় ভেঙে এগিয়ে আসছে সাগর। কোটালের সময় ফুলেফেঁপে গ্রাম ভাসিয়ে নিয়ে যায় গ্রামের একাংশ। কচিকাঁচারা সেই জল ঠেঙিয়েই স্কুলে যায়। বানভাসি জলে গ্রামের মাটির বা়ড়ির দেওয়াল, মেঝেতেও স্যাঁতস্যাঁতে ভাব। বাগডাঙা থেকে বালিয়াড়া গ্রামে যাওয়ার পথে দেখা গেল, এক দিকে চাষের জমি সব সাদাটে হয়ে গিয়েছে। সঙ্গী টোটোচালক বললেন, ‘‘জোয়ারের জলে সব নোনা ধরে গিয়েছে। ও সব জমিতে আর চাষ হয় না।’’ অথচ নামখানা ব্লকে আনাজ চাষে মৌসুনির সুনাম জানেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার কর্তাব্যক্তিরাও।

গ্রামের যুবক মনসুর বেগ জানালেন, সম্প্রতি যে-গভীর নিম্নচাপ হাজির হয়েছিল সাগরে, তার জেরে গ্রামের কবরখানার মাটি ধুয়ে কঙ্কাল বেরিয়ে এসেছিল। কোনও মতে ফের মাটি চাপা দিয়ে মৃতদের ‘সম্মান’-টুকু বাঁচিয়েছেন মনসুরেরা। কাছেই এক ফালি জমি দেখিয়ে এক যুবক বলছিলেন, ‘‘এই তো এখানেই আমাদের বাড়ি ছিল। ভাঙনের ভয়ে গ্রামের অন্য দিকে সরে গিয়েছি।’’

পরিবেশবিদেরা বলছেন, বিশ্ব উষ্ণায়নের জেরে ঘূর্ণিঝ়ড়ের প্রকোপ বা়ড়বে, বাড়বে সাগরের জলস্তর। তার জেরেই ক্রমশ বিপন্ন হয়ে পড়ছে সুন্দরবনের ব-দ্বীপ এলাকা এবং ম্যানগ্রোভ অরণ্য। এই এলাকা ও অরণ্য না-থাকলে কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গের বড় একটি অংশও সামুদ্রিক ঝড়ের মুখে বিপন্ন হয়ে পড়বে বলে সতর্ক করছেন পরিবেশবিজ্ঞানীরা। এই পরিস্থিতিতে মৌসুনির মতো বিপন্ন এলাকা নিয়ে কী ভাবছে প্রশাসন?

স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান আদালত খান জানান, আয়লার পরে নাবার্ড বাঁধের কাজ শুরু করেছিল। কিন্তু অর্ধেক হওয়ার পরে সেই কাজ বন্ধ হয়ে যায়। সেই বাঁধও ভেঙেচুরে জলের গ্রাসে চলে গিয়েছে। প্রতি মাসেই একটু একটু করে জলের গ্রাসে ডুবে যাচ্ছে দ্বীপটি। স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, এক বার বাঁধের জন্য জমি গিয়েছে তাঁদের। ফের বাঁধের নামে জমি নেওয়া হবে। এ ভাবে কত বার জমি দেবেন তাঁরা। নামখানা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি শ্রীকান্তকুমার মালি মেনে নিচ্ছেন, বাঁধের ক্ষেত্রে সমস্যা আসলে টাকার। এই বিপন্ন গ্রামকে বাঁচাতে বাঁধ দেওয়ার জন্য অন্তত ৩০ কোটি টাকার বরাদ্দ প্রয়োজন। তিনি বলেন, ‘‘কিছু টাকা মিলেছে। তা দিয়ে বাঁধের কাজ শুরু করা হবে।’’

যদিও এই আশ্বাসে নিশ্চিন্ত হচ্ছেন না গ্রামবাসীদের অনেকেই। তাঁদের বক্তব্য, ফি বছর ভোটের আগেই এমন নানা স্বপ্ন দেখান রাজনীতির লোকেরা। ভোট মিটতেই সবাই প্রতিশ্রুতি ভোলে।

ভাঙনের ভয় নিয়ে রাত জাগে শুধু মৌসুনি।

Mousuni Island মৌসুনি দ্বীপ Landslide
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy