Advertisement
১৯ মে ২০২৪

পুজোয় কন্ট্রোল রুম গুটিয়ে শব্দের লাগাম ছাড়ল পর্ষদই

মণ্ডপে মণ্ডপে অঞ্জলির তোড়জোড় তখন তুঙ্গে। অষ্টমীর সেই সকালে পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অফিসার-কর্মীরা বার্তাটা পেয়েছিলেন। যার সারমর্ম— এ বারের মতো পর্ষদের পুজো কন্ট্রোল রুম উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পুজোর দিনে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সব রকম নজরদারিও বন্ধ হচ্ছে।

সুরবেক বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:৩৯
Share: Save:

মণ্ডপে মণ্ডপে অঞ্জলির তোড়জোড় তখন তুঙ্গে। অষ্টমীর সেই সকালে পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অফিসার-কর্মীরা বার্তাটা পেয়েছিলেন। যার সারমর্ম— এ বারের মতো পর্ষদের পুজো কন্ট্রোল রুম উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পুজোর দিনে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সব রকম নজরদারিও বন্ধ হচ্ছে।

খোদ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সদস্য-সচিবের জারি করা নির্দেশিকাটির জেরে রাজ্যে এ বার দুর্গাপুজো হয়েছে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের কন্ট্রোল রুম আর নজরদারি ছাড়াই। বাইশ বছরে এ-ই প্রথম! তার ফল?

বারাসত থেকে বেহালা— নালিশ ও আক্ষেপের ঢল নেমেছে। বহু লোকের অভিযোগ, পুজোর সময়ে মাইক শুধু তারস্বরেই বাজেনি, নির্ধারিত সময় অর্থাৎ রাত দশটার পরেও বেজেছে। কোথাও জলসা শুরুই হয়েছে রাত দশটার পরে। রাতভর মাইক বাজিয়ে নাচা-গানা চলেছে। বিসর্জনের মিছিলে পিলে চমকানো শব্দে বাজি ফেটেছে আকাশে, মাটিতে। মাঝরাতের জলসায় ‘ডিজে’-র হুঙ্কারে পাড়া কেঁপেছে। অতিষ্ঠ বাসিন্দারা প্রতিকার চেয়ে স্থানীয় থানায় ফোন করলে পরামর্শ মিলেছে— দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের কন্ট্রোল রুমে জানান।

কিন্তু যেখানে কন্ট্রোল রুমেরই অস্তিত্ব নেই, সেখানে কোথায় অভিযোগ জানানো যাবে, তার উত্তর কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। পর্ষদ আচমকা কন্ট্রোল রুম তুলে নিল কেন?

পর্ষদের সদস্য-সচিব সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের যুক্তি— ‘‘আমরা কন্ট্রোল রুম খুলে নজরদারি চালালেও যা করার পুলিশকেই করতে হয়। তাই এ বার কন্ট্রোল‌ রুম রাখার প্রয়োজনীয়তা দেখিনি।’’ ওঁর দাবি— পর্ষদকর্মীরা পুলিশের কন্ট্রোল‌ রুমেই সামিল হয়েছিলেন, এবং পুলিশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শব্দদূষণের বিরুদ্ধে অভিযান চলেছে। যদিও লালবাজার কন্ট্রোলের এক কর্তা জানিয়েছেন, পুজোর ক’দিন পর্ষদের কেউ তাঁদের সঙ্গে ছিলেন না। ‘‘ষষ্ঠী থেকে বিসর্জন পর্যন্ত মাইক ও শব্দবাজি নিয়ে নালিশেরও অন্ত ছিল না।’’— বলছেন ওই পুলিশকর্তা।

এমতাবস্থায় শব্দদানবের দাপাদাপির জন্য প্রশাসনের দিকে আঙুল উঠছে। পরিবেশকর্মীদের বক্তব্য: রাত দশটার পরে প্রকাশ্যে মাইক ব্যবহারে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ৯০ ডেসিবেলের বেশি শব্দের বাজি ফাটানোও নিষেধ। পুলিশ দেখবে, নিয়ম যেন মানা হয়।

কিন্তু আইন ভাঙতে দেখেও আইনরক্ষকেরা হাত গুটিয়ে থাকছেন বলে অভিযোগ। কুমোরটুলির এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘ঠাকুর নিতে এসে সারা রাত বাজনা বাজিয়ে তুলকালাম বাধানো হচ্ছে। মহালয়ার পরে ছ’দিন রাতের ঘুম চৌপাট।’’ ওঁদের প্রশ্ন, এখানে সব সময় পুলিশ মোতায়েন থাকা সত্ত্বেও কী ভাবে এমনটা হয়?

এই পরিস্থিতিতে পর্ষদ নিজে থেকে পুজোর সময় কন্ট্রোল রুম গুটিয়ে নেওয়ায় পরিবেশকর্মীরা থ। ‘‘ব্যাপারটা ভয়ানক। ভাবা যাচ্ছে না!’’— প্রতিক্রিয়া পরিবেশকর্মী নব দত্তের। তাঁর পর্যবেক্ষণ, ‘‘পর্ষদ আদতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ধরেই নিচ্ছি, তারা আর নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করবে না।’’ পরিবেশকর্মী তথা পর্ষদের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য আইন-আধিকারিক বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘শব্দের তাণ্ডবে লাগাম পরিয়ে মানুষকে স্বস্তি দেওয়া পর্ষদের দায়িত্ব। পুজোয় তাদের এই বেনজির সিদ্ধান্তে আমজনতা নরকযন্ত্রণা ভোগ করেছে।’’

স্বভাবতই সিদ্ধান্তের পিছনে কোনও যুক্তি ওঁরা দেখতে পাচ্ছেন না। ঘটনা হল, শব্দদূষণের অভিযোগ পুলিশেও করা যায়। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পুলিশ আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু উৎসবের সময়ে পুলি‌শ আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় এ দিকে তেমন নজর দিতে পারে না। তাই নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি নাগাদ পর্ষদ প্রথম পুজোয় কন্ট্রোল রুম খুলে নিজের টিম রাস্তায় নামায়। সল্টলেকের পরিবেশ ভবন ও পর্ষদের আটটি আঞ্চলিক অফিস— গত বছর পর্যন্ত পুজোয় মোট এই ন’টি কন্ট্রোল রুম কাজ করেছে, সপ্তমী থেকে দশমী। সেখানে আসা অভিযোগ কখনও পুলিশকে পাঠানো হতো, কখনও পর্ষদ নিজেই সরেজমিন তদন্তে যেত।

সেই আয়োজনে এ বার পূর্ণাঙ্গ দাঁড়ি। এবং এমন এক সময়ে, যার ক’দিন আগে অভিযোগ উঠেছিল, বিজয়গড়ে অসুস্থ এক মহিলা শব্দবাজির তাণ্ডবে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। তার পরেও নজরদারি বন্ধের ফরমানে রাতিমতো সিঁদুরে মেঘ দেখছেন পরিবেশকর্মীরা। দশমীর ভাসানে শব্দদৈত্যের চোখরাঙানির মধ্যেই তাঁরা কালীপুজো-দিওয়ালির শব্দ-ছবির আভাস পাচ্ছেন।

‘‘ট্রেলারই যদি এ-ই হয়, তা হলে গোটা ছবির কথা ভেবে তো শিউরে উঠছি,’’ বলেন এক পরিবেশকর্মী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sound pollution
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE