Advertisement
E-Paper

বাদাবনের ভাঁড়ার শূন্য, বাঘ ঢুকছে লোকালয়ে

তার উঠোন জুড়ে থিক থিক করছে কাদা। নোনা জলের তোড়ে খোয়া যেতে বসেছে তার ভাঁড়ার। ছড়ানো উঠোনের মতো, দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে, তার অবাধ বিচরণভূমের চেহারা গত এক দশকে আমূল বদলে গিয়েছে। বাদাবন জুড়ে তৃণভোজীর যে অফুরন্ত ভাঁড়ার ছিল, হারিয়ে যেতে বসেছে তা-ও।

রাহুল রায়

শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:২০

তার উঠোন জুড়ে থিক থিক করছে কাদা। নোনা জলের তোড়ে খোয়া যেতে বসেছে তার ভাঁড়ার।

ছড়ানো উঠোনের মতো, দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে, তার অবাধ বিচরণভূমের চেহারা গত এক দশকে আমূল বদলে গিয়েছে।

বাদাবন জুড়ে তৃণভোজীর যে অফুরন্ত ভাঁড়ার ছিল, হারিয়ে যেতে বসেছে তা-ও।

এই অবস্থায় বাঘের (প্যানথেরা টাইগ্রিস টাইগ্রিস) আদর্শ ঠিকানা হিসেবে সুন্দরবনকে আর প্রথম সারিতে রাখা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। গত জানুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় ভূ-বিজ্ঞান মন্ত্রকের উপগ্রহ চিত্রে ধরা পড়েছে, পৃথিবীর বৃহত্তম এই বদ্বীপ ক্রমেই সমুদ্রের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে।

তা আঁচ করেই কি নিজের ঠিকানা বদলে ফেলছে বাঘ, পশ্চিমবঙ্গের বাদাবন ছেড়ে সে কি আরও পূর্বে, বাংলাদেশের সুন্দরবনে পাড়ি দিচ্ছে?

সে সম্ভাবনায় অবশ্য জল ঢেলে দিয়েছেন বাংলাদেশের বনকতার্রা। সে দেশের, সুন্দরবন-সংরক্ষণে নিয়োজিত সংস্থাগুলির কাছেও তেমন কোনও আশার কথা শোনা যায়নি।

ইউনেস্কোর বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে কয়েক বছর ধরে কাজ করছে ‘সেভ সুন্দরবন অব বাংলাদেশ’ সংক্ষেপে এসএসবি নামে একটি সংস্থা। সংস্থার তরফে আব্বাস মোশারফ জানাচ্ছেন, উষ্ণায়নের ছায়ায় ঢেকেছে বাংলাদেশের সুন্দরবনও।

আয়লার আগে সেখানে আছড়ে পড়েছিল দুই বিধ্বংসী ঝড়, ‘নার্গিস’ ও ‘সিডার’। এসএসবি-র সমীক্ষা বলছে, বাংলাদেশের সুন্দরবনে জলস্তর বাড়তে থাকে তার পর থেকেই।

আব্বাস বলেন, ‘‘নাগির্স আর সিডার আমাদের সুন্দরবনের অর্ধেক বাদাবনই ধ্বংস করে দিয়ে গিয়েছে। আস্বাভাবিক হারে বেড়ে গিয়েছে জমির ক্ষয়। গত পাঁচ-সাত বছরে সুন্দরবনের বিভিন্ন দ্বীপ থেকে ধীরে ধীরে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছে বাঘও।’’

জলোচ্ছ্বাসের দাপটে দুই বাংলার সুন্দরবন থেকেই ভিটে-হারা ব্যাঘ্রকুল। আর, সে জন্যাই কি লোকালয়ে বেড়ে গিয়েছে দক্ষিণ রায়ের আনাগোনা? বাঘ সংরক্ষণে দেশের সর্বোচ্চ সংস্থা ন্যাশনাল টাইগার কনজারভেশন অথরিটি-র (এনসিটিএ) এক বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘বন ছেড়ে লোকালয়ে ঘন ঘন বাঘের আসা যাওয়ার এটাও একটা কারণ হতে পারে।’’

সুন্দরবনের যে সব দ্বীপে জনবসত রয়েছে তার অধিকাংশই জমিদারি বাঁধের অনুশাসনে সংরক্ষিত। সে সব দ্বীপে জলোচ্ছ্বাসের আঘাত সীমিত। বছর কয়েক আগেও, শুধু শীতের মুখে প্রসূতি বাঘিনির পা পড়ত সে সব দ্বীপে। পুরুষ বাঘের রোষ থেকে সদ্যোজাতদের রক্ষা করতেই বাঘিনি তার আঁতুরঘর হিসেবে বেছে নিত ধানি জমি। আর, এখন লোকালয়ে তাদের আনাগোনা সম্বৎসর।

এ ব্যাপারে বাঘ-বিশারদ বিশ্বজিৎ রায়চোধুরীর সংযোজন, ‘‘জলোচ্ছ্বাসে দ্বীপের বাদাবন নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তৃণভোজীরা অর্থাৎ বাঘের ভাঁড়ার ঘরই শূন্য হয়ে গিয়েছে। খিদের জ্বালায় লোকালয়ে গরু-ছাগলের খোঁজেও তাই পা পড়ছে বাঘের।’’

নিজের বাসস্থান ছোট হয়ে আসায়, বাঘের প্রজননের উপরেও ছায়া ফেলেছে বলে মনে করছেন বিশিষ্ট বাঘ বিশেষজ্ঞ ইন্দ্রজিৎ সংখালা। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘বাঘ প্রায় ২০ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে তার নিজস্ব এলাকা বা ‘টেরিটরি’ গড়ে তোলে। সুন্দরবনে ক্রমশ সংকীর্ণ হয়ে আসা দ্বীপে সেই সুযোগ কোথায়? এই স্থান সঙ্কুলান বাঘের প্রজননের উপরেই ছায়া ফেলেছে।’’

সুন্দরবনের কাকদ্বীপ, ঘোড়ামারা, সাগর, দক্ষিণ সুরেন্দ্রনগর থেকে ভাঙাদুনি, ধনচি, ধুলিভাসানি—বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে প্রায় ৪৯ বর্গ কিলোমিটার জমি গত পনেরো বছরে তলিয়ে গিয়েছে জলোচ্ছ্বাসে।

২০০১-২০০৯, দীর্ঘ আট বছর ধরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ এবং ডব্লু ডব্লু এফ যৌথ ভাবে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল। তাঁদের রিপোর্ট বলছে, ওই আট বছরে তলিয়ে গিয়েছে সুন্দরবনের ৩৭ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত বনাঞ্চল। ২০০৯-এর পরবর্তী পাঁচ বছরে তা আরও বেড়েছে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তুলনায় বিভিন্ন দ্বীপে বিস্তার হয়েছে জলাজমির (প্রায় ৮ শতাংশ)। সেই সঙ্গে, আয়লার পরে জলস্তর ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ায় মাইলের পর মাইল জুড়ে চাষযোগ্য জমিও হারিয়ে গিয়েছে (প্রায় ৪৫৮ বর্গ কিলোমিটার) সুন্দরবনে।

নিরন্তর জমি ক্ষয়ের ফলে আড়ে-বহরে ছোট হয়ে এসেছে দ্বীপগুলি। সুন্দরবনের বদ্বীপের তালিকায় প্রথম দিকেই ছিল দক্ষিণ সুরেন্দ্রনগর। গত পনেরো বছরে জলোচ্ছ্বাসে সে দ্বীপের প্রায় ২.৩২ বর্গ কিলোমিটার এলাকা হারিয়ে গিয়েছে। সাগর দ্বীপ থেকে হারিয়ে গিয়েছে প্রায় ৫.৩৪ বর্গ কিলোমিটার এলাকা। ঘোড়ামারা (১.৪ বর্গ কিলোমিটার), ভাঙাদুনি (৬.৫ বর্গ কিলোমিটার), জম্বুদ্বীপেরও একই হাল (২ বর্গ কিলোমিটার)।

সমুদ্রের ভ্রূকুটি সত্ত্বেও বাদাবনের দেওয়াল তুলে এখনও জেগে আছে দ্বীপ। কিন্তু বাঘের ঘরে জলের থাবায় তা আর কত দিন?

(শেষ)

sundarban tigers sundarban villagers rahul roy sundarban in danger sundarban flood sundarban crisis
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy