Advertisement
E-Paper

জুলুমে জোড়া পদত্যাগ, কাঠগড়ায় তৃণমূল

বদলায় না স্বশাসিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকারি হস্তক্ষেপের ইতিহাস। তাই জারি থাকে শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের জুলুমও। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চৌহদ্দির মধ্যে অশান্তির মুখে পড়ে রাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং একটি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের ইস্তফার পর বিতর্কটা ফের মাথাচাড়া দিল।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০১৫ ০৪:০১
বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট আটকে চলছে বিক্ষোভ। তাই এ ভাবেই যাতায়াত। বৃহস্পতিবার সজল চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট আটকে চলছে বিক্ষোভ। তাই এ ভাবেই যাতায়াত। বৃহস্পতিবার সজল চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

বদলায় না স্বশাসিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকারি হস্তক্ষেপের ইতিহাস। তাই জারি থাকে শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের জুলুমও।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চৌহদ্দির মধ্যে অশান্তির মুখে পড়ে রাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং একটি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের ইস্তফার পর বিতর্কটা ফের মাথাচাড়া দিল। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রতনলাল হাংলু বুধবার দুপুর থেকে রাতভর ঘেরাও হয়ে ছিলেন। ওই দিন দুপুরেই আলিপুরদুয়ার কলেজে নিগৃহীত হন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শৈলেন দেবনাথ। বুধবারই পদত্যাগ করেছিলেন শৈলেনবাবু। বৃহস্পতিবার রাজ্যপালের কাছে ইস্তফাপত্র পাঠিয়ে দেন রতনলাল হাংলুও। কারও ইস্তফাই গৃহীত হয়নি। কিন্তু দু’টি ঘটনাতেই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আঙুল উঠেছে শাসক দলের দিকে।

শিক্ষাবিদদের একটা বড় অংশই মনে করছেন, বাম আমলে রাজ্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে কার্যত একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। সেই ঐতিহ্যই আরও ডালপালা মেলেছে তৃণমূল আমলে। এবং বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অশান্তিতে তৃণমূলের জুলুমের এত অভিযোগ উঠে আসার কারণ একটাই।

স্বশাসিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লাগাতার সরকারি হস্তক্ষেপ।

কখনও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন উপাচার্যের ইস্তফার কথা। কখনও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনায় আচার্যকে ডিঙিয়ে সরাসরি উপাচার্যের কাছে রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। বিশ্ববিদ্যালয়ে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে সেই শিক্ষামন্ত্রীই সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। স্বশাসনে হস্তক্ষেপ নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনিই সাফ বলেছেন, ‘‘একশো বার নাক গলাব, মাইনেটা তো আমিই দিই।’’

অনেকের মতে, সরকারি তৎপরতার এমন সব উদাহরণ সামনে থাকায় শাসক দলের ছাত্র নেতারাও এখন ভাবতে শুরু করেছেন, স্বশাসিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হস্তক্ষেপের অধিকারটা তাঁদেরও রয়েছে। এবং সেই কারণেই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁদের দাপট লাগামছাড়া হয়ে উঠেছে।

কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘেরাও শুরু হয়েছিল ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে। পড়ুয়াদের সঙ্গে জুটে যায় কিছু বহিরাগতও। বুধবার দুপুর থেকে উপাচার্যের ঘরের সামনে যে ঘেরাও-বিক্ষোভ শুরু হয়, তা চলে রাতভর। আটকে পড়েন বিভিন্ন ফ্যাকাল্টির ডিন-সহ বহু কর্মী ও আধিকারিক। এ দিন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এক দিকে বলেছেন, যাদবপুর বা প্রেসিডেন্সির ঢঙে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ‘হাততালি দিয়ে উচ্ছৃঙ্খল আন্দোলন’ তিনি বরদাস্ত করবেন না। কিন্তু একই সঙ্গে কল্যাণীতে অশান্তির দায় কার্যত উপাচার্যের উপরেই চাপিয়ে দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘‘সমস্যাগুলি উপাচার্যই তৈরি করছেন।’’

কেন এমন মনে করছেন শিক্ষামন্ত্রী?

পার্থবাবুর যুক্তি, ‘‘এক লাফে, কোনও আলোচনা ছাড়াই প্রায় পাঁচ গুণ ভর্তি-ফি বাড়িয়ে দেওয়া কোনও কাজের কথা নয়। তা ঠিক হয়নি বলেই আমি মনে করছি।’’ পক্ষান্তরে সাংবাদিক বৈঠকে উপাচার্য হাংলু জানিয়েছেন, পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্যই প্রায় বারো বছর পরে গত ২০১৪-’১৫ শিক্ষাবর্ষে ফি বাড়ানো হয়। এমনকী বর্ধিত ফি শিক্ষামন্ত্রীর অনুরোধে একপ্রস্ত কমানোও হয়েছে বলে দাবি করেন উপাচার্য। তাঁর ক্ষোভ, ‘‘যখন ফি কমানো হল, তখন সবাই মেনে নিলেন। এখন বহিরাগতদের উস্কানিতে ফের শুরু হয়েছে আন্দোলন।’’

কারা সেই বহিরাগত, ভেঙে বলেননি উপাচার্য। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্তার দাবি, ‘‘বিভিন্ন কাজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখন ই-টেন্ডার ডাকায় অস্বচ্ছতার কোনও সুযোগ নেই। উপাচার্য কড়াকড়ি করায় নিয়োগ প্রক্রিয়ায় খবরদারিও করতে পারেননি শাসক দলের স্থানীয় নেতাদের একাংশ। ফলে ক্ষোভের কারণের অভাব নেই।’’ সিপিএমের নদিয়া জেলা সম্পাদক সুমিত দে-র কথায়, ‘‘প্রথমে এটা ছিল ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন। পরে তৃণমূল সেখানে ঢুকে পরিস্থিতি উচ্ছৃঙ্খল করে তোলে।’’

খোদ শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য উড়িয়ে দিয়েছেন এই ‘তত্ত্ব’। পার্থবাবুর মন্তব্য, ‘‘কেউ উপাচার্যের ইস্তফা দাবি করেনি। আমার সঙ্গে ওঁর কথা হয়েছে। অথচ, উনি আমাকে এক বারও এই বিষয়ে কিছু বলেননি।’’ পার্থবাবুর দাবি, উপাচার্য তাঁকে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে অনুরোধ করেছেন। কিন্তু তিনি যাবেন না। কেন? শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেই তো উপাচার্য আবার সংবাদমাধ্যমকে ডাকবেন। ফের আপনারা স্বাধিকার ভঙ্গ হচ্ছে বলে ‘গেল-গেল’ রব তুলবেন।’’ যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি কমানো-বাড়ানো নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর এ দিনের মন্তব্যও আখেরে সেই স্বাধিকারে হস্তক্ষেপের নামান্তর বলে মনে করছেন অনেকে।

আলিপুরদুয়ার কলেজ প্রসঙ্গে অবশ্য ‌শিক্ষামন্ত্রীর অন্য সুর। সেখানে প্রথম বর্ষে পড়ুয়া ভর্তির সময়সীমা বাড়ানোর দাবিতে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে মিলে কিছু বহিরাগত অধ্যক্ষের ঘরে টিভি, টেলিফোন থেকে সিসিটিভি ক্যামেরা ভাঙে, ফুটেজ সংরক্ষণের যন্ত্রটি লুঠ করে এবং অধ্যক্ষকে হেনস্থা করে বলে অভিযোগ। কাকুতি-মিনতি করে রেহাই পান তিনি। শিক্ষামন্ত্রীর কথায়, ‘‘অধ্যক্ষকে বলেছি ইস্তফা দেওয়া চলবে না। ওই কলেজে ছাত্র সংসদের যে শাখাটি (তৃণমূল ছাত্র পরিষদের) আছে, সেটি ভেঙে দিয়েছি। তাতে যদি আমার বিরুদ্ধে স্বাধিকার ভঙ্গের প্রশ্ন ওঠে, তো উঠবে।’’

পার্থবাবুর নির্দেশেই এ দিন কলেজে পরিস্থিতি দেখতে যান জেলা তৃণমূল সভাপতি সৌরভ চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘‘ছাত্রেরা ভুল করলে তাদের শাসন করা হবে। ঘটনার পিছনে বহিরাগতেরা রয়েছে তা স্পষ্ট। প্রশাসন আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে।” পুলিশ জানিয়েছে, অভিযুক্ত তিন জনের মধ্যে এক জন সিভিক ভলান্টিয়ার। তাদের খোঁজ চলছে।

আপাতত ছুটিতে থাকা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শৈলেনবাবু অবশ্য মন্ত্রী তথা শাসক দলের আশ্বাস পেয়েও আশ্বস্ত হচ্ছেন না। তাঁর বক্তব্য, “শিক্ষামন্ত্রী ছাত্র সংসদ ভেঙে দেবেন বলে আমাকে জানিয়েছেন। কিন্তু কলেজে গিয়ে যদি দেখি, যারা হামলা চালিয়েছে তারা বহাল তবিয়তে ঘুরছে, তা মানতে পারব না। তাই মন্ত্রী যা বলেছেন তা করেন কি না, দেখার পরেই কাজে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেব।”

tmc trouble two vc resignation kalyani university vc viswabharati university vc resigned ratanlal hanglu sushanta duttagupta tmc problem
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy