Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ভোটের বাজিমাতে সেই ‘তারা-বাজি’ তৃণমূলে

আবেদন এসেছে ফরাক্কা থেকে। সংগঠনের হাল খারাপ জানিয়ে মুর্শিদাবাদের ওই বিধানসভা কেন্দ্রে এ বার তারকা-মুখ পাঠানোর কাতর আর্জি জানিয়েছেন স্থানীয় ব্লক তৃণমূল নেতৃত্ব। দলের রাজ্য নেতৃত্বের কাছে তাঁদের দাবি, টলিউডের ভাণ্ডার থেকে সোহম অথবা নুসরত, এই দুই রতনের কোনও একটি তুলে এনে পাঠানো হোক ফরাক্কায়। কংগ্রেসের অনেক দিনের ঘাঁটিতে তাতে যদি ঘাসফুল ফোটার আশা দেখা দেয়!

সন্দীপন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ১৪:২৫
Share: Save:

আবেদন এসেছে ফরাক্কা থেকে। সংগঠনের হাল খারাপ জানিয়ে মুর্শিদাবাদের ওই বিধানসভা কেন্দ্রে এ বার তারকা-মুখ পাঠানোর কাতর আর্জি জানিয়েছেন স্থানীয় ব্লক তৃণমূল নেতৃত্ব। দলের রাজ্য নেতৃত্বের কাছে তাঁদের দাবি, টলিউডের ভাণ্ডার থেকে সোহম অথবা নুসরত, এই দুই রতনের কোনও একটি তুলে এনে পাঠানো হোক ফরাক্কায়। কংগ্রেসের অনেক দিনের ঘাঁটিতে তাতে যদি ঘাসফুল ফোটার আশা দেখা দেয়!

ফরাক্কার তৃণমূল নেতাদের এই যুক্তিকে অবশ্য বিশেষ আমল দিতে রাজি নন মুর্শিদাবাদ জেলা নেতৃত্ব। কিন্তু তারকা-প্রার্থনা তাতে থামছে না! উত্তর হাওড়া যেমন। সেখানকার বিধায়ক এখন তৃণমূলেরই। স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলে দিয়েছেন, একান্তই বিশেষ পরিস্থিতি না এলে বর্তমান বিধায়কদের সরানো হবে না। কিন্তু উত্তর হাওড়ায় শাসক দলের গোষ্ঠী-কোন্দল বিধায়কের রাস্তায় কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আবার বিকল্প নামের জন্যও এত তদ্বির, তাতেও অশান্তি! দলের একাংশ তাই চাইছেন টলিউডের মুখ এবং অধুনা তৃণমূল নেতা রুদ্রনীল ঘোষকে সেখানে প্রার্থী করতে। একই অবস্থা বালিরও। সেখানে ভাবনা চলছে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বাংলার ক্রিকেটার লক্ষ্মীরতন শুক্লকে নিয়ে।

হুগলিতে এখন সিপিএমের হাতে আছে শুধু পাণ্ডুয়া কেন্দ্র। ওই আসনে তৃণমূলের টিকিটে প্রার্থী করার ভাবনা নিয়ে কথাবার্তা চালানো হচ্ছে ফুটবলার রহিম নবির সঙ্গে। শাসক দলে নাম লিখিয়ে প্রার্থী হতে ইচ্ছুক বৈশালী ডালমিয়াও। তিনি অবশ্য তারকা নন। তবে প্রয়াত পিতা জগমোহন ডালমিয়ার নামের একটা ওজন আছে বৈকি! যদিও তাঁর জন্য দক্ষিণ কলকাতা বা শহরতলিতে কেন্দ্র খুঁজে বার করাই বড় মাথাব্যথা মমতার দলের! গৌতম সরকার-সহ এক ঝাঁক প্রাক্তন ক্রীড়াবিদ এবং টলিউড-টেলিউডের আরও কিছু নাম নিয়ে জল্পনাও ভেসে আছে অনেক দিন।

তারকাদের প্রতি তৃণমূল নেত্রীর দুর্বলতা অবশ্য বহু দিনের। তাপস পাল, শতাব্দী রায়, নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়দের রাজনীতির আঙিনায় টেনে আনার কাজ তিনিই করেছিলেন। কিন্তু রাজ্যের শাসন পাটে বসে তৃণমূল রাজ্যের প্রায় সর্বত্র একচ্ছত্র দাপট প্রতিষ্ঠা করে ফেলার পরেও কেন তারকার সন্ধান করতে হয়, প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই। শাসক দলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘সমাজের সব অংশের প্রতিনিধিরা আমাদের দলনেত্রীর সঙ্গে আছেন, তারকারা দলীয় প্রতীকে প্রার্থী হলে সেটা দেখানো যায়। তাতে সাধারণ মানুষের উপরেও প্রভাব পড়ে। আর কোথাও কোথাও সংগঠনের সমস্যা ঢাকতেও তারকাদের কাজে লাগানো যায়।’’

লোকসভা ভোটে যেমন ঠিক সেই কাজটাই করেছিলেন মমতা। ঘাটালের মতো আসনে দেব, বাসুদেব আচারিয়ার মতো লাগাতার জিতে আসা প্রবীণ নেতার বিরুদ্ধে মুনমুন সেন, মেদিনীপুরের মতো ‘কঠিন’ আসনে সন্ধ্যা রায়— ঘোড়া ছিল তাঁর। প্রথমে বিস্তর হইহই পড়েছিল দলের মধ্যেও। পরে এই সব ঘোড়াই বাজিমাত করে বেরিয়ে এল! নানা সমস্যা-অভিযোগ সত্ত্বেও তাপস-শতাব্দীদের টিকিট বাদ দেননি মমতা। গত লোকসভা ভোটের প্রচারে শতাব্দী যখন বীরভূমে গিয়ে বললেন, আগে আপনারা পয়সা দিয়ে আমাকে দেখতেন (সিনেমা বা যাত্রায়), এখন বিনা পয়সায় দেখতে পাবেন, বিতর্ক হল প্রবল। কিন্তু মমতা তাঁদের উপরেই ভরসা রেখেছেন এবং জিতেছেন! এ বারের বিধানসভায় বাম-কংগ্রেস জোট বেঁধে বহু ক্ষেত্রে যখন তৃণমূলকে শক্ত চ্যালেঞ্জে ফেলার পরিকল্পনা নিচ্ছে, তৃণমূল নেত্রীও তাঁর তারকা-তাস গুছিয়ে রাখছেন!

সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপি তারকা-রাজনীতির পথিকৃৎ। রামায়ণ, মহাভারতের মতো মহাকাব্যিক টেলি সিরিয়ালের চরিত্রদের তারা সেই কবেই ভোটের ময়দানে টেনে এনেছিল! কংগ্রেসও কখনও সখনও অমিতাভ বচ্চন থেকে রাজেশ খন্না বা হালফিল নাগমাদের এনেছে ঠিকই। কিন্তু বিজেপি-র ধারাবাহিক ‘গ্ল্যামার কোশেন্টে’র সঙ্গে তারা ঠিক এঁটে উঠতে পারেনি! দক্ষিণ ভারতের রাজনীতিতে আবার তারকাদের দাপটই আলাদা। তবে সে তল্লাটে রুপোলি পর্দার চরিত্রেরা সেলুলয়েড দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে রাজনীতির বলয়েরই পাকাপাকি বাসিন্দা হয়ে যান বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। সাবেক অন্ধ্রপ্রদেশের এনটি রামা রাও থেকে তামিলনাড়ুর এমজি রামচন্দ্রন, জয়ললিতা বা চিরঞ্জীবীদের উদাহরণ সে কথাই বলছে। বঙ্গ রাজনীতিতে সে অর্থে তারকা-স্রোত মমতার হাত ধরেই।

কেউ বলতে পারেন, কেন অনিল চট্টোপাধ্যায়, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়, অজিত পাণ্ডেদের কি বামেরা নিয়ে আসেনি? এনেছিল। কিন্তু ঘটনা হল, তাঁরা চলচ্চিত্র বা শিল্প-সংস্কৃতি জগৎ থেকে আসা অ-রাজনৈতিক চরিত্র ছিলেন না। মতাদর্শে, ভাবনায়, ঘরানায় তাঁদের বামপন্থী পরিচয় ছিলই। সিপিএম তাঁদের আনুষ্ঠানিক ভাবে নির্বাচনী রাজনীতির পতাকা তুলে দিয়েছিল। তৃণমূল নেত্রী এসে এই নীতি চালু করে দিলেন- ‘অ-রাজনৈতিক’ কিন্তু নামডাক আছে, অতএব তাঁকে নিয়ে এসো ঘাসফুলে!

রাজনীতির লড়াইয়ে সাংগঠনিক টক্করের আগে তারকা নামিয়ে দিয়ে কাজ হাসিলের পাশাপাশি কোনও বিড়ম্বনায় মমতাকে পড়তে হয়নি, তা অবশ্য নয়! যাদবপুরের প্রাক্তন সাংসদ কবীর সুমনের বৃত্তান্ত এখনও তেমন পুরনো হয়নি! গত বিধানসভায় জিতে-আসা এমন কয়েকটি মুখকে নিয়ে এখনও প্রবল অস্বস্তি রয়েছে শাসক দলে। উত্তরপাড়ায় অনুপ ঘোষাল আবার টিকিট পাবেন, তৃণমূলের কেউই হলফ করে বলতে পারছেন না! রায়দিঘির দেবশ্রী রায় এবং বারাসতের চিরঞ্জিৎকে নিয়েও বিব্রত তৃণমূল। দেবশ্রীকে যেমন স্থানীয় তৃণমূল চায়নি, তেমনই ‘বিধায়ক নিখোঁজ’ জাতীয় প্রচার সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেয়ে দিয়েছে বিরোধীরা! দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের সভাপতি শোভন চট্টোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপে এ যাত্রাতেও দেবশ্রীর টিকিটটা অবশ্য বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। চিরঞ্জিৎকে নিয়ে প্রশ্নটা হালকা করে ঝুলে রয়েছে!

তবে তৃণমূল এ সবে দমছে না! সোহম, হিরণ (দু’জনেই এখন তৃণমূলের পদাধিকারী), লক্ষ্মী— রতন তুলে এনেই চলেছে তারা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE