Advertisement
E-Paper

ভাবমূর্তি বাঁচাতে আরাবুল বিদায়

চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত আরাবুল ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! ভাঙড়-কাণ্ডের চার দিন পরে ভাঙড়ের প্রাক্তন বিধায়ক এবং ভাঙড় দুই নম্বর ব্লকের পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি আরাবুল ও তাঁর সঙ্গী জাহাঙ্গির খান চৌধুরীকে দল থেকে ৬ বছরের জন্য বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। যাঁকে প্রকাশ্যেই ‘গুরু’ বলে মেনেছিলেন আরাবুল!

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:৩৮

চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত আরাবুল ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়!

ভাঙড়-কাণ্ডের চার দিন পরে ভাঙড়ের প্রাক্তন বিধায়ক এবং ভাঙড় দুই নম্বর ব্লকের পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি আরাবুল ও তাঁর সঙ্গী জাহাঙ্গির খান চৌধুরীকে দল থেকে ৬ বছরের জন্য বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। যাঁকে প্রকাশ্যেই ‘গুরু’ বলে মেনেছিলেন আরাবুল!

ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া অবশ্য তৃণমূল নেতৃত্বের সামনে পথ ছিল না। রাজনৈতিক এবং সামাজিক ভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ছিল শাসক দল। ভাবমূর্তি উদ্ধারের চাপের কাছে শেষ পর্যন্ত নতিস্বীকার করতে হল তৃণমূল নেত্রীকে। ঠিক যেমন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীর বিরুদ্ধে অশালীন আচরণের ঘটনায় ব্যবস্থা নিতেও প্রথমে টালবাহানা করেছে মমতা-সরকার। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাওয়ায় ঘটনার প্রায় সাড়ে তিন সপ্তাহ পরে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে পুলিশ। কিন্তু ভাবমূর্তি উদ্ধারের চেষ্টায় ফল হবে কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কারণ, দলীয় স্তরে শাস্তি দিলেও আরাবুলের বিরুদ্ধে এখনও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন।

পার্থ-ঘনিষ্ঠ আরাবুলের পাশাপাশি এলাকায় তাঁর ঘোর বিরোধী, মুকুল রায়ের কাছের লোক বলে পরিচিত কাইজার মণ্ডলকেও শাস্তি দিয়েছে দল। তবে তাঁকে বহিষ্কার নয়, সরানো হয়েছে দলীয় পদ থেকে। ভাঙড় এক নম্বরের তিনটি অঞ্চলে দলের সভাপতি পদ থেকে কাইজারের অপসারণের কথা ঘোষণা করেছেন তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী। যা দলে পার্থ এবং মুকুলের নিয়ন্ত্রণে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

আরাবুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াটা যে নিতান্তই চাপে পড়ে, সেটা বুঝতে খুব বেশি বুদ্ধি খরচ করার দরকার পড়ে না। এলাকায় সিন্ডিকেট-তোলাবাজি থেকে শুরু কলেজের শিক্ষিকার দিকে জগ ছোড়া বা প্রবীণ বিধায়ক আব্দুর রেজ্জাক মোল্লাকে আক্রমণ গত কয়েক বছরে একের পর এক ঘটনায় অভিযুক্ত হয়েছেন আরাবুল। কিন্তু ভাঙড় থেকে হাজার হাজার ভোটে লিড দেওয়া নেতাকে ঘাঁটাতে সাহস পায়নি শাসক দল। আরাবুলকে বহিষ্কারের পরে রেজ্জাক তাই বলেছেন, “এ তো চোখে ধুলো দেওয়া! আরাবুল যখন সিপিএম বা বিরোধীদের মেরে সাফ করেছে, তখন সাত খুন মাফ! এখন তৃণমূলকে মারছে দেখে বহিষ্কার!” তাঁর আরও প্রশ্ন, “বহিষ্কার আবার ৬ বছরের জন্য কেন? তার মানে যে কোনও দিন ঘরে ডেকে নেওয়ার রাস্তা খোলা!”

সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন

খুন-জখম, হামলা, আক্রান্তদের অভিযোগ দায়ের করতে না-দেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগে পুলিশ-প্রশাসন এখন আরাবুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে কি না, সেটা প্রশ্ন। শাসক দল কি পুলিশকে সেই ‘অনুমতি’ দেবে? রেজ্জাক অবশ্য বলেছেন, “এখনও তো পুলিশ কিছু করেনি। আসলে এ বার একটা ছাড়া-গরু রাখা হল। যাকে পারবে গুঁতোবে, এর ফসল খাবে, ওর বেড়া ভাঙবে আর তৃণমূল বলবে, ও তো আমাদের কেউ নয়!” যদিও পার্থবাবু বলেছেন, প্রশাসনের তদন্ত শেষ না-হওয়া পর্যন্ত একটু অপেক্ষা করতে হবে।

ভাঙড়-কাণ্ড নিয়ে এ দিন দলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির বৈঠকে ছিলেন পার্থবাবু, সুব্রতবাবু ও দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। পরে পার্থবাবু বলেন, “শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির বৈঠকে আরাবুলদের বহিষ্কারের সুপারিশ করা হয়। দল সেই সুপারিশ অনুমোদন করেছে।” দলীয় সূত্রের খবর, এ দিন নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে নেতাদের আলোচনা হয়। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বহিষ্কার হন আরাবুলরা। পার্থবাবুর ব্যাখ্যা, “প্রাথমিক তদন্তে দলের মনে হয়েছে, ভাঙড়ে গোলমালের পিছনে ওঁদের (আরাবুলদের) ভূমিকা আছে।” ওই ঘটনায় আরও অনেকের নামেই অভিযোগ রয়েছে। পার্থবাবুর বক্তব্য, “তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। এর পরে কারও নাম যদি তদন্তে উঠে আসে, তবে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

তবে তৃণমূলেরই একাংশের মত, পার্থবাবুর ‘স্নেহধন্য’ বলেই আরাবুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দলীয় নেতৃত্ব প্রথমে টালবাহানা করেছেন। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। দলীয় নেতৃত্বের একাংশের বক্তব্য, পার্থবাবু কোনও কাজ শুরু করেও সুচারু ভাবে শেষ করতে পারেন না! যাদবপুর-কাণ্ডেও একই হাল হয়েছে শিক্ষামন্ত্রীর। সাংগঠনিক প্রশ্নে মুকুলবাবু যে দক্ষতা দেখিয়েছেন, সেটা পার্থবাবুর নেই। তাই পার্থ-ঘনিষ্ঠ আরাবুল বহিষ্কৃত হয়েছেন, আর মুকুল-ঘনিষ্ঠ কাইজার তুলনায় লঘু শাস্তিতে পার পেয়ে গিয়েছেন। পার্থবাবু অবশ্য নিজেকে আরাবুলের ‘গুরু’ বা ‘গডফাদার’ বলে মানতে চাননি। তাঁর কথায়, “আরাবুলের গডফাদার যদি কেউ হয়ে থাকে, তবে তা দল!” তবে ঘটনা হল, পার্থবাবু শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার দিনই আরাবুল ফুল নিয়ে বিকাশ ভবনে তাঁর ‘গুরু’কে সম্মান জানাতে গিয়েছিলেন।

ভাঙড়-কাণ্ডের বহু আগেই নানা অপকীর্তিতে নাম জড়ানো ভাঙড়ের এই দাপুটে নেতার বিরুদ্ধে এত দিন কেন দল ব্যবস্থা নেয়নি, তা নিয়ে তৃণমূলের অন্দরেই নানা ব্যাখ্যা আছে। একাংশের মতে, আরাবুল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ বলেই তাঁকে ছুঁতে সাহস পেতেন না দলীয় নেতৃত্ব। অন্য অংশের মতে, ভাঙড়ে সিপিএমের মোকাবিলার জন্য আরাবুলের মতো ডাকাবুকো নেতাই দরকার ছিল তৃণমূলের। গত বিধানসভা ভোটে প্রবল তৃণমূলের হাওয়াতেও আরাবুল জিততে পারেননি। কিন্তু তাতেও তাঁর দাপট কমেনি। এক বছর আগে ভাঙড়ের কাঁটাতলায় রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী রেজ্জাক মোল্লাও রেহাই পাননি আরাবুলের হাত থেকে। কিন্তু সে দিনও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি তৃণমূল।

এ বারের ভাঙড়-কাণ্ডের ভুক্তভোগীরা শুধু বহিষ্কারের সিদ্ধান্তেই খুশি নন। নিহত রমেশ ঘোষালের দিদি নিয়তি মুখোপাধ্যায় যেমন বলেছেন, “ফোঁটা দিতে গিয়ে ভাইকে রক্তে ভাসতে দেখলাম। আরাবুলকে শুধু বহিষ্কার করলেই হবে না! এই ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের প্রত্যেকের শাস্তি দেখতে চাই।” পাঁচু মণ্ডলের স্ত্রী লক্ষ্মী মণ্ডলও বলেছেন, “যারা আমার স্বামী-ছেলেকে আক্রমণ করল, যাদের মদতে আমার স্বামী-ছেলেদের ফাঁসানো হল, তাদের সকলের শাস্তি চাই। তবে আরাবুলের বহিষ্কারের খবরটা শুনে কিছুটা হালকা লাগছে।”

এখন আরও প্রশ্ন, অন্য ‘আরাবুল’দের কী হবে? এফআইআরে নাম থাকা বীরভূমের অনুব্রত মণ্ডল, মনিরুল ইসলাম বা তাপস পালের বিরুদ্ধে এত দিন দল কেন ব্যবস্থা নেয়নি? পার্থবাবুর জবাব, “এর পর তো দেখছি শক, হূণ আমলে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, সেই প্রশ্ন উঠবে!”

tmc partha chattopadhyay arabul islam bhangor latest news online news
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy