Advertisement
১৮ মে ২০২৪

সারদা বিড়ম্বনার মধ্যেই তাপস-কাঁটা

সারদা-বিড়ম্বনার বোঝার উপরে চাপল তাপস-বিতর্কের ভার। তাপস পাল শাসকদলের সাংসদ বলেই উস্কানিমূলক বক্তব্য পেশের অভিযোগ থেকে রাজ্য সরকার তাঁকে আড়াল করতে চাইছে কি না, বুধবার সরাসরি সেই প্রশ্ন তুলল কলকাতা হাইকোর্ট।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:২৫
Share: Save:

সারদা-বিড়ম্বনার বোঝার উপরে চাপল তাপস-বিতর্কের ভার। তাপস পাল শাসকদলের সাংসদ বলেই উস্কানিমূলক বক্তব্য পেশের অভিযোগ থেকে রাজ্য সরকার তাঁকে আড়াল করতে চাইছে কি না, বুধবার সরাসরি সেই প্রশ্ন তুলল কলকাতা হাইকোর্ট। যাতে রাজ্য সরকার তথা তৃণমূল নেতৃত্ব বাড়তি চাপের মুখে পড়ল বলে প্রশাসনের অন্দরে ধারণা তৈরি হয়েছে। তাপস-কাণ্ডে আদালতের পর্যবেক্ষণকে হাতিয়ার করে ইতিমধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাতে শুরু করেছে বিরোধীরাও।

কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ তাপসবাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগ: গত জুন মাসে নদিয়ার পাঁচ জায়গায় প্রকাশ্য সভায় তিনি প্ররোচনা ও বিদ্বেষমূলক নানা মন্তব্য করেছেন। এ জন্য সাংসদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের প্রশ্নে এ দিন হাইকোর্টে চূড়ান্ত শুনানি শুরু হয়েছে, বিচারপতি নিশীথা মাত্রের বেঞ্চে। তাপস-মামলায় এর আগে বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তার সমালোচনা করেছিলেন। এবং এ দিনও নানা প্রসঙ্গে তাপস-কাণ্ডে সরকারি ভূমিকা সম্পর্কে সংশয়ের সুর ঘুরে-ফিরে উঠে এসেছে বিচারপতি মাত্রের মন্তব্যে। ‘‘তাপস পাল শাসকদলের সাংসদ বলেই কি রাজ্য ব্যাপারটা চাপা দিতে চাইছে?” সরকারপক্ষের কাছে জানতে চেয়েছেন তিনি।

পাশাপাশি রাজ্য সরকার কেন এই মামলায় তাপস পালের হয়ে সওয়াল করছে, আদালতের সেটাও প্রশ্ন। শুনানি চলাকালীন রাজ্যের কৌঁসুলি তথা তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে উদ্দেশ করে বিচারপতি মাত্রে বলেন, “আপনি রাজ্য। আপনাকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে। আপনি কারও হয়ে ওকালতি করতে পারেন না।” একই সঙ্গে নাম না-করে কার্টুন-কাণ্ডে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে গ্রেফতারের প্রসঙ্গটি টেনে এনে বিচারপতির মন্তব্য, “এখানে এখন সাধারণ লোকে ইন্টারনেটে কিছু আপলোড করলেও পুলিশ ধরছে! আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে!”

তাপস-মামলায় বিচারপতি মাত্রের রায়ই হবে চূড়ান্ত। কোনও পক্ষ ডিভিশন বেঞ্চে তা চ্যালেঞ্জ করতে পারবে না, কেননা ডিভিশন বেঞ্চের দুই বিচারপতি ভিন্নমত হওয়ার পরেই নিষ্পত্তির জন্য মামলাটি মাত্রে-এজলাসে এসেছে। আর সেখানে প্রথম দিনের শুনানিতে আদালতের যা প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ, তাতে নবান্নের কর্তারা স্বভাবতই বিব্রত। বিশেষত সিবিআইয়ের সারদা-তদন্তের প্রেক্ষাপটে শাসকদলের সাম্প্রতিক অস্বস্তিকে তাপস-মামলা জোরদার করল বলেই প্রশাসনিক মহলের একাংশের অভিমত। কংগ্রেস থেকে বিজেপি আদালতের পর্যবেক্ষণের প্রেক্ষিতে বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও এ দিন রাজ্য প্রশাসনের সমালোচনায় মুখর হয়েছে।

বস্তুত এ দিন শুনানির গোড়া থেকে বিবিধ মন্তব্যের মাধ্যমে আদালত নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। এজলাস বসতেই তাপসবাবুর কৌঁসুলি কিশোর দত্ত জানিয়েছিলেন, মক্কেল অসুস্থ থাকায় তাঁর থেকে তিনি মামলা সংক্রান্ত কোনও নির্দেশ পাননি। বিচারপতি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, “এ জন্য শুনানি মুলতুবি রাখা যায় না।” এর পরেই তিনি সরকারপক্ষের কৌঁসুলির বক্তব্য জানতে চান। কল্যাণবাবু বলেন, “মূল অভিযোগ হল, পুলিশ এফআইআর নেয়নি। এটা আদালতগ্রাহ্য অপরাধ কি না, সেটাও বিচার্য।” শুনে বিচারপতি বলেন, “আপনি রাজ্য। আপনাকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে। আপনি কারও হয়ে সওয়াল করতে পারেন না। আপনার উচিত ছিল, মামলাকারীকে ডেকে ডিজ্ঞাসাবাদ করা। করেছেন?”

কল্যাণবাবু জানান, করেননি। তাঁর যুক্তি, এটা জনস্বার্থ-মামলা নয়। উপরন্তু বিচারপতি দত্তের সিঙ্গল বেঞ্চযে ভাবে ধারা নির্দিষ্ট করে মামলা করতে বলেছে, সেটা তার এক্তিয়ারের বাইরে বলে দাবি করেন সরকারপক্ষের কৌঁসুলি। বিচারপতি মাত্রে জবাব দেন, “সিঙ্গল বেঞ্চ প্রাথমিক ভাবে যে যে ধারা প্রয়োগ হওয়া উচিত বলে মনে করেছে, সেটাই বলেছে। বলেনি যে, প্রয়োগ করতেই হবে।” কল্যাণবাবুর পাল্টা দাবি, সিঙ্গল বেঞ্চের সে কথা বলারও এক্তিয়ার নেই। সরকারি কৌঁসুলির অভিমত শুনে আদালতের মন্তব্য, “চারপাশে কী ঘটছে, বিচারপতি তা দেখবেন না? তিনি কি গজদন্ত মিনারে বসে থাকবেন?”

সাংসদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে প্রশাসন কী পদক্ষেপ করেছে, এ বার বিচারপতি তা সরকারপক্ষের কাছে জানতে চান। কল্যাণবাবুকে বলেন, “আপনি একটা অভিযোগ পেয়েছেন। সরকারের কথা অনুযায়ী, ২ জুলাই আপনি সেটি গ্রহণ করেছেন। একটি টিভি চ্যানেলের কাছে অসংশোধিত ফুটেজ (তাপসের সেই বক্তৃতার) চেয়েছেন। ওই ভিডিও ফুটেজ পাওয়ার জন্য তার পরে আর কিছু করেননি? কেউ কি বাধা দিয়েছে?” কল্যাণবাবুর ব্যাখ্যা, বিষয়টি আদালতের বিচার্য হওয়ায় তাঁরা আর এগোননি। শুনে বিচারপতির প্রশ্ন, “সিঙ্গল বেঞ্চ কি পুলিশকে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে বলেছিল?”

এবং আদালতের পর্যবেক্ষণ, “রাজ্য সরকার আসলে ঠিকই করে ফেলেছে যে, এটা আদালতগ্রাহ্য অপরাধ নয়।” জবাবে সরকারপক্ষের সওয়াল, “আমরা বলছি না যে, কোনও অপরাধ নয়। শুধু বলছি, আদালতগ্রাহ্য অপরাধ নয়।” শুনে বিচারপতি মাত্রের মন্তব্য, “উনি (তাপস পাল) এমন কিছু না-ই বলে থাকলে ক্ষমা চাইলেন কেন? উনি নিজে জানেন, কী বলেছেন! এখন আপনি বলছেন, আদালতগ্রাহ্য অপরাধ নয়!”

এ হেন যুক্তি তাঁর পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন বলে জানিয়ে দেন বিচারপতি। কল্যাণবাবু তখন বলেন, তাঁদের কাছে সাংসদের বক্তৃতার ভিডিও ফুটেজ নেই। “আমরা চেয়েও পাইনি।” অভিযোগ করেন তিনি। মামলাকারী বিপ্লব চৌধুরীর কৌঁসুলি অনিরূদ্ধ চট্টোপাধ্যায় পাল্টা দাবি করেন, তাঁরা সরকারপক্ষকে ফুটেজ দিয়েছেন। দু’পক্ষের বক্তব্য শুনে বিচারপতি কল্যাণবাবুকে জিজ্ঞাসা করেন, অভিযোগকারীকে ডেকে পাঠিয়ে তিনি ফুটেজ চেয়েছিলেন কি না। কল্যাণবাবু চাননি শুনে বিচারপতি ফের তির্যক মন্তব্য করেন। “তা হলেই বুঝুন! তদন্ত কী হয়েছে, পরিষ্কার! রাজ্যের ভূমিকা হচ্ছে আড়াল করা।” বলেন তিনি।

আর এই সময়েই বিচারপতি প্রশ্ন তোলেন, “অভিযুক্ত শাসকদলের সাংসদ বলেই কি সরকার বিষয়টি চাপা দিতে চাইছে? কার্টুন-কাণ্ডের প্রসঙ্গটিও তিনি টেনে আনেন। তার পরে কল্যাণবাবুকে জিজ্ঞাসা করেন, “আপনারা শুধু এক জনের কাছে ফুটেজ চেয়ে বসে থাকলেন? আরও তো অনেক টিভি চ্যানেল রয়েছে! তাদের কাছে চেয়েছেন?” বিচারপতি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, এখানেই রাজ্যের ভূমিকা সম্পর্কে তাঁর সন্দেহ জাগছে। আবেদনকারী সরাসরি হাইকোর্টে চলে এলেন কেন, কল্যাণবাবু সেই প্রশ্ন তুললে বিচারপতি বলেন, পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার কারণেই হাইকোর্টকে এগিয়ে আসতে হচ্ছে। “মামলাকারী তো পরে হাইকোর্টে এসেছেন। তত দিন পুলিশ কী করছিল?” জানতে চান তিনি। বিচারপতির আরও প্রশ্ন, ‘নাকাশিপাড়ায় থানা জেনারেল ডায়েরি করার পরে অনেক সময় পেয়েছিল অভিযোগ খতিয়ে দেখে এফআইআর দায়ের করার। তা করেনি কেন?” একটা সময়ে বিচারপতি মাত্রে হেসে কল্যাণবাবুকে বলেন, “আপনি এত পরিশ্রম করে এত নথি জোগাড় করেছেন! অভিযোগকারীর অভিযোগকে সেই গুরুত্ব দিলে তো এত কিছুর দরকারই পড়ত না!”

দ্বিতীয় দফায় দুপুর দু’টো নাগাদ এজলাস ফের বসে। সওয়াল-জবাবের মাঝে বাদীপক্ষের কৌঁসুলি অনিরুদ্ধবাবু কোর্টকে জানান, দিন দুই আগে তাঁর মক্কেলকে সরকারের তরফে একটা চিঠির প্রতিলিপি দেওয়া হয়েছে। এক সহ-সচিবের লেখা ৩০ জুলাই তারিখের চিঠিটিতে রাজ্য পুলিশের ডিজি-কে বলা হয়েছে, সাংসদের বক্তব্য সম্পর্কে অনুসন্ধান করে রিপোর্ট জমা দিতে। বিচারপতি কল্যাণবাবুর কাছে জানতে চান, ওই চিঠির ভিত্তিতে কী ব্যবস্থা হয়েছে? কল্যাণবাবু বলেন, সরকারের তরফে তাঁকে এ ব্যাপারে কিছু জানানো হয়নি। তিনি জেনে নিয়ে আদালতকে অবহিত করবেন।

বিকেল সওয়া চারটে নাগাদ শুনানি শেষ হয়। আজ, বৃহস্পতিবার ফের শুনানি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE