Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
জবরদখল এক্সপ্রেস

পুলিশ, মাফিয়া নিয়ে খড়্গপুর তৃণমূলেরই

এপ্রিলের শেষবেলায় যখন পুরসভাগুলির ফল বেরোয়, তৃণমূল নেতৃত্ব প্রত্যয়ী ছিলেন, ত্রিশঙ্কু পুরবোর্ডগুলি তাঁরা দখল করবেন। খোদ তৃণমূল নেত্রী বলেছিলেন সে কথা। এই অভিযানে অবশ্য শিলিগুড়িতে আটকে যায় তৃণমূল। শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেও উত্তরবঙ্গের ওই গুরুত্বপূর্ণ বোর্ডটি নিজেদের কব্জায় আনতে পারেনি তারা। খড়্গপুরে কিন্তু সেই ‘অঘটন’ ঘটল না! দীর্ঘ সওয়া এক মাসের নাটক শেষে বৃহস্পতিবার ১৯-১৫ ফলে বোর্ড জিতে নিল শাসক দল।

হাতে হাত। পুরবোর্ড গঠনের পর পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষের সঙ্গে তৃণমূলের খড়্গপুর শহর সভাপতি দেবাশিস চৌধুরী। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

হাতে হাত। পুরবোর্ড গঠনের পর পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষের সঙ্গে তৃণমূলের খড়্গপুর শহর সভাপতি দেবাশিস চৌধুরী। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

দেবমাল্য বাগচী
খড়্গপুর শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৫ ০৩:৪৪
Share: Save:

এপ্রিলের শেষবেলায় যখন পুরসভাগুলির ফল বেরোয়, তৃণমূল নেতৃত্ব প্রত্যয়ী ছিলেন, ত্রিশঙ্কু পুরবোর্ডগুলি তাঁরা দখল করবেন। খোদ তৃণমূল নেত্রী বলেছিলেন সে কথা। এই অভিযানে অবশ্য শিলিগুড়িতে আটকে যায় তৃণমূল। শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেও উত্তরবঙ্গের ওই গুরুত্বপূর্ণ বোর্ডটি নিজেদের কব্জায় আনতে পারেনি তারা। খড়্গপুরে কিন্তু সেই ‘অঘটন’ ঘটল না! দীর্ঘ সওয়া এক মাসের নাটক শেষে বৃহস্পতিবার ১৯-১৫ ফলে বোর্ড জিতে নিল শাসক দল।

অথচ ২৮ এপ্রিল যখন ফল বার হয়, তখন তৃণমূল ও কংগ্রেস সমান সমান। অর্থাত্, জনাদেশ পক্ষে ছিল না তৃণমূলের। বরং বাম-কংগ্রেস একজোট হয়ে বোর্ড গঠনের সম্ভাবনাই তৈরি হচ্ছিল। এই অবস্থায় তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্ব তত্পরতা শুরু করে দেন। রেল মাফিয়া শ্রীনু নায়ডুর কাছেও যান এক তৃণমূল কাউন্সিলর। শ্রীনু তখন জেলে। এর পরে তাঁর জামিনও হয়। বিরোধীদের অভিযোগ, শ্রীনু বাইরে আসার পরেই তাঁদের হুমকি দেওয়া, বাড়িতে চড়াও হয়ে হামলা, গুলি— একে একে সবই ঘটতে থাকে! এবং সব ক্ষেত্রেই তাঁরা শাসক দলকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। এই ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে একে একে ভাঙতে থাকে বিভিন্ন দলের ঘর। প্রথমে বিজেপি। শ্রীনুর স্ত্রী পূজা এবং আরও তিন কাউন্সিলর দল ভেঙে বেরিয়ে তৃণমূলে যোগ দেন। তার পরে ভাঙে সিপিআই। দু’দফায় তাদেরও দুই কাউন্সিলর তৃণমূলে যোগ দেন। বুধবারই সব মিলিয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যায় পৌঁছে গিয়েছিল শাসক দল। বৃহস্পতিবার তাই বোর্ড দখলে তাদের কোনও অসুবিধাই হয়নি।

বিরোধীরা বলছেন, দখলের নেপথ্যে কী আছে সেটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে দু’টি ঘটনায়। এক, পয়লা মে তৃণমূল কাউন্সিলর জহরলাল পালের জেলে গিয়ে রেল মাফিয়া শ্রীনু নায়ডুর সঙ্গে সাক্ষাত্। পরে আরও এক বার তিনি শ্রীনুকে দেখতে গিয়েছিলেন। তখন তাঁর সঙ্গে শ্রীনুর স্ত্রী পূজা। দেওয়াল লিখন তখনই পরিষ্কার হয়ে যায়। এবং দুই, বৃহস্পতিবার জয়ের পরে তৃণমূলের খড়্গপুর শহর সভাপতির সঙ্গে পশ্চিম মেদিনীপুরের এসপি ভারতী ঘোষের করমর্দন। কংগ্রেস, বাম ও বিজেপি, তিন বিরোধীরই প্রশ্ন, পুলিশ-মাফিয়া-দুষ্কৃতীর এমন রামধনু জোটের ছবি আগে কি কখনও দেখা গিয়েছে? খড়্গপুরের বিখ্যাত চাচা, বিধায়ক জ্ঞানসিংহ সোহন পাল বলেছেন, ‘‘জীবনে অনেক ভোট দেখেছি। কিন্তু পুরবোর্ড দখল করতে তৃণমূল যে নোংরা রাজনীতি করল, তা কল্পনা করা যায় না। বুঝতে পারছি না এই জয়ের জন্য কাকে অভিনন্দন জানাব, পুলিশকে, দুষ্কৃতীদের না তৃণমূলকে!’’

বিরোধীদের একটা বড় অংশ অবশ্য এই ‘জয়’কে খড়্গপুরেই আটকে রাখতে চাইছেন না। বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য যেমন বলেছেন, ‘‘এই উপসর্গ এখন রাজ্যের সর্বত্র। ভোটে জয় নিশ্চিত জানার পরেও জোর করে ছিনিয়ে নেওয়ার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে শাসক দলে। এবং সেটা করতে গিয়ে প্রয়োজনে গুলি-বোমার আশ্রয়ও নিচ্ছে তারা। না হলে হুমকি-মামলা।’’

এই প্রসঙ্গে বিরোধীরা তুলেছেন কলকাতা পুরভোটের কথা। এবিপি আনন্দের সমীক্ষা অনুযায়ী এ বারে এই বোর্ড রমরম করে জেতার কথা তৃণমূলের। একাই একশো ছাড়িয়ে যাবে তারা, এমনই পূর্বাভাস ছিল সমীক্ষায়। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের কথায়, ‘‘এতে কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারেননি তৃণমূল নেতৃত্ব। সে জন্য গোপাল তিওয়ারির মতো দুষ্কৃতীদের নামানো হয়েছিল।’’ কেউ গুলি-বন্দুকে দাপিয়ে বেরিয়েছে উত্তর কলকাতা। কেউ দক্ষিণে তাড়া করে গিয়েছে কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো বিরোধী নেতাদের। সন্ত্রাসের এমন সামগ্রিক চেহারা তৈরি করে পূর্বাভাসের ১০৪-১০৫কে বাড়িয়ে ১২০-১২৫ আসন করার চেষ্টা করা হয়েছে।

কেন? তৃণমূলের অন্দরেই কেউ কেউ বলছেন, দলের লক্ষ্য ছিল বিরোধীশূন্য পুরসভা। অর্থাত্, কলকাতায় বিরোধীদের যত্সামান্যতে নামিয়ে আনা ও ত্রিশঙ্কু পুরসভাগুলিও যেনতেন প্রকারে দখল নেওয়া। এই ব্যাপারে খোদ মমতারই একটি কথাকে তুলে ধরছেন বিরোধীরা। পুরভোটের ফল নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি জানিয়েছিলেন, ত্রিশঙ্কু বোর্ডগুলিও তৃণমূলের হাতেই আসবে।

বস্তুত, শিলিগুড়িতে সে ভাবেই এগিয়েছিল তৃণমূল। সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে অনেকটা পিছনে থাকা সত্ত্বেও গৌতম দেব এবং নান্টু পালেরা চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। নেপালে ভূমিকম্পের ত্রাণ পাঠাতে সেই সময় উত্তরবঙ্গে গিয়েছিলেন মমতা। তিনি শিলিগুড়ির তৃণমূল কাউন্সিলরদের সঙ্গে বৈঠকও করেন। তার পরেই বিরোধী শিবিরে আতঙ্ক তৈরি হয় দল অটুট রাখা নিয়ে। একটি আসন পেলেই বামেরা বোর্ড দখল করে নেবে— এমন পরিস্থিতিতেও ভরসা রাখতে পারছিলেন না সিপিএম নেতা তথা বামেদের মেয়র প্রার্থী অশোক ভট্টাচার্য। তিনি জয়ী কাউন্সিলরদের নিয়ে দার্জিলিঙে চলে যান। বামেদের সমর্থন জানাবেন— এ কথা ঘোষণা করে এলাকা ছাড়েন নির্দল প্রার্থী অরবিন্দ দাসও (অমুদা)। বামেরা বলছেন, এই অবস্থায় শেষ পর্যন্ত শিলিগুড়ির আশা ছেড়ে দেয় তৃণমূল। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, যদিও এর আগে তারা দল ভাঙানোর জন্য জয়ী কাউন্সিলরদের লোভ দেখানো থেকে হুমকি, সবই চালিয়ে গিয়েছে পুরোদমে।

শিলিগুড়িতে যে অস্ত্র কাজ করেনি, খড়্গপুরের তাতেই ঘায়েল হলেন বিরোধীরা। খড়্গপুরের বাসিন্দারা বলছেন, বিরোধী জোটে নেতা না

থাকাটাই বড় কারণ। শিলিগুড়িতে অশোক ভট্টাচার্য সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে যা করে দেখিয়েছেন, সেটা রেল শহরে ঘটেনি। ফলে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তা হারিয়েছেন বিরোধীরা।

প্রদেশ কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া বলেছেন, ‘‘পেশী শক্তি, হুমকি বা লোভ দেখিয়ে হেরে যাওয়া বোর্ড দখলের খেলা শুরু হয় মুকুল রায়ের আমলে। জনাদেশ না থাকলেও বোর্ড বা পঞ্চায়েত নিজেদের দিকে টানার ঢল নেমেছিল তখন। বিরোধীশূন্য করে দেওয়ার মনোভাবও তখনই জন্ম নেয়।’’ একে ‘হিটলারি মনোভাব’ বলেও বর্ণনা করেছেন বহু বিরোধী নেতা। এ বারেও তার বিরাম নেই। মামলার হুমকি দিয়ে, গুলি-বোমা ছুড়ে, কাউন্সিলরের বাড়িতে হামলা চালিয়ে, মহিলা কাউন্সিলর হলে তাঁর স্বামীকে পিটিয়ে বোর্ড দখলের অভিযান চলল খড়্গপুরেও- অভিযোগ বিরোধীদের।

তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য এই সব অভিযোগে কান দিচ্ছেন না। খড়্গপুরে বসে এ দিনের প্রক্রিয়াটি যিনি তদারকি করেছেন, সেই পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “পুলিশ বা মাফিয়াদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নেই। হেরে গিয়ে এ সব বলা শোভা পায় না।” পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ তো তৃণমূল নেতার সঙ্গে করমর্দনের প্রশ্ন শুনে চটেই লাল! বলেছেন, ‘‘কার সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করব, সেটাও কি সংবাদমাধ্যম বলে দেবে!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE