কিষানগঞ্জ হাসপাতালে এক ছাত্রের দেহ। বৃহস্পতিবার। — নিজস্ব চিত্র।
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে রামপুর মোড়ে ছুটে আসেন চাকুলিয়ার বাসিন্দা উৎপল মজুমদার। লোকজনের ভিড় ঠেলে কোনও মতে এগিয়ে যান সামনে। তার পরেই বসে পড়েন রাস্তায়। সামনেই পড়ে রয়েছে তাঁর ছেলে অর্ণব। রক্তে ভেসে যাচ্ছে রাস্তা। চারপাশে তখন আতঙ্কের আর্তনাদ।
উত্তর দিনাজপুরের চাকুলিয়ায় ভুল রুটে ঢুকে-আসা কয়লা-বোঝাই ট্রাকের ধাক্কায় দুমড়ে যায় স্কুলের একটি পুল কার। পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায় ছয় শিশু। প্রত্যেকেই প্রথম শ্রেণির পড়ুয়া, সকলেরই বয়স ছয় বছর। গুরুতর আহত ওই গাড়িতে থাকা আরও ৭ শিশু। গাড়ির চালকের অবস্থাও আশঙ্কাজনক।
কানকি ফাঁড়ির পুলিশ জানিয়েছে, দুর্ঘটনায় মৃত শিশুদের নাম হিমেশ সেন, গোপাল সরকার, অর্ণব মজুমদার, ঋক দাস, শাহি আজমি, ও মিরচাঁদ হোসেন। ট্রাকের চালক ও খালাসি পলাতক।
বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা নাগাদ চাকুলিয়া থানার কানকি ফাঁড়ির অদূরে ৩১ নম্বর জাতীয় সড়কে এই দুর্ঘটনার পরে এলাকার মানুষ উত্তেজিত হয়ে অবরোধ শুরু করেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিধি ভেঙে একমুখী সড়কে ঢুকে পড়া একটি
দশ চাকার ট্রাকই এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। টোলগেট এড়ানোর জন্যই কিছু ট্রাক ফোর লেনের যে দিক শুধু শিলিগুড়ি যাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট করা রয়েছে, সেখানে জোর করে ঢুকে পড়ে। স্থানীয় মানুষজনের অভিযোগ, ট্রাকগুলো এ ভাবে বিধি ভাঙার জন্য মাঝেমধ্যেই এই এলাকায় দুর্ঘটনা ঘটে। পুলিশ ঘুষ নিয়ে ট্রাক ছেড়ে দেয়। এমন নানা অভিযোগ তুলে অবরোধ শুরু করেন বাসিন্দারা।
এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, মাত্র ২ কিলোমিটার দূরেই পুলিশের ফাঁড়ি। অথচ ঘটনার পরে পুলিশ পৌঁছতে এক ঘণ্টা লেগে যায়। ঘটনাস্থলে পুলিশ পৌঁছলে জনতার একাংশ কর্তব্যরত পুলিশকর্মীদের গাড়ি থেকে নামিয়ে মারধর করে। পুলিশের জিপ ভেঙে দেয়। পুলিশকর্মীরা পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেন। এর পরে বিশাল পুলিশ বাহিনী ঘটনাস্থলে গিয়ে শতাধিক রাউন্ড কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। ছোড়া হয় রবার বুলেটও। তাতেও রাত পর্যন্ত পরিস্থিতি শান্ত হয়নি। দলমত নির্বিশেষে স্থানীয় বাসিন্দারা অবরোধ জারি রাখেন। সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা নাগাদ সেই অবরোধ ওঠে।
উত্তর দিনাজপুরের পুলিশ সুপার সৈয়দ ওয়াকার রেজার বক্তব্য, ‘‘যদি কোনও পুলিশকর্মী এমন করে থাকেন, তা হলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ওই এলাকায় পুলিশের ভূমিকা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’ উত্তরবঙ্গের আইজি এন রমেশবাবু জানিয়েছেন, পুলিশের বিরুদ্ধে যাবতীয় অভিযোগ খতিয়ে দেখে পদক্ষেপ করা হবে।
স্থানীয় সূত্র ও পুলিশ সূত্রে খবর, বিহারের কিষানগঞ্জের একটি বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ত ওই শিশুরা। স্কুলের নিজস্ব বাস নেই। চাকুলিয়া থেকে অনেকেই ওই বাচ্চাদের পড়তে পাঠান। ইসলামপুরের চাকুলিয়া থেকে বোলেরো গাড়িতে পড়ুয়ারা রোজ যাতায়াত করে। স্কুল ছুটির পরে বেলা ২টো নাগাদ পুল কারটি জাতীয় সড়কের রামপুর মোড়ে পৌঁছয়। চার লেনের মহাসড়ক হওয়ায় একমুখী রাস্তায় পুল-কারটি বেশ জোরেই ছুটছিল। কিন্তু, ওই সময়ে উল্টো দিক থেকে আইন ভেঙে একমুখী সড়কে ঢুকে পড়ে কয়লা বোঝাই দশচাকার ট্রাকটি। ইতিমধ্যে বোলেরো গাড়িটি আর একটি গাড়িকে ওভারটেক করে এগোতে যায়। তখনই উল্টো দিক থেকে আসা ট্রাকটির সঙ্গে ধাক্কা লেগে সেটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়।
ওই রাস্তায় নিত্যযাত্রী দেবব্রত ধর জানান, বাসের চালকের কাছে দুর্ঘটনার কথা শুনে তিনি এগিয়ে যান। বলেন, ‘‘তাকিয়ে দেখি, গাড়িটার মধ্যে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে শিশুরা। কেউ কাঁদছে। কেউ নড়াচড়া করছে না। স্কুল ব্যাগ, টিফিন বক্স, জুতো-মোজা— সবই রক্তে ভেসে যাচ্ছে।’’ তিনি জানান, পুলিশ আসে ঘণ্টাখানেক বাদে। তত ক্ষণে এলাকার মানুষই হাতে হাতে শিশুদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে। অনেক অভিভাবকও পৌছে গিয়েছেন। সকলেই উদভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি করছেন, কাঁদছেন। জাতীয় সড়কে শুধুই কান্নার রোল।
যেখানে দুর্ঘটনা ঘটে, সেখান থেকে সব চেয়ে কাছের হাসপাতাল কিষানগঞ্জ মেডিক্যাল কলেজ। তাই শিশুদের উদ্ধার করে সেখানেই প্রথম নিয়ে যাওয়া হয়। বিকেল নাগাদ সেখানে পৌঁছে দেখা গেল, অভিভাবকেরা কেউ দু’হাতে মুখ
ঢেকে বসে রয়েছেন। কেউ নিথর শিশুকে কোলে নিয়ে অঝোরে কেঁদে চলেছেন। শিশুর রক্তমাখা ব্যাগ, টিফিন বাক্স আঁকড়ে আর্তনাদ করছেন কেউ। কে, কাকে সান্ত্বনা দেবেন? পাড়া-পড়শি তো বটেই, অচেনা লোকজনও একসঙ্গে ছ’টি শিশুর দেহ দেখে শোকস্তব্ধ। সন্তানহারা বাবা-মায়ের হাহাকার বদলে দিয়েছিল বিহারের হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চেনা চেহারাটা।
কে এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী, কাঁদতে কাঁদতেই সে প্রশ্ন করছিলেন মৃত শিশুদের পরিজনরা। এক জন
প্রশ্ন করলেন, ‘‘কী করে ট্রাক ভুল রুটে ঢুকে পড়ল সেটা কে দেখবে? যাঁদের দোষে ট্রাক উল্টো পথে ঢোকে সেই পুলিশকে কে খুঁজে বার করবে?
আমরা ট্রাকের চালক, পুলিশ, সকলের সাজা চাই।’’
এক অভিভাবক নিজে সরকারি কর্মী। আক্ষেপ করে বললেন, ‘‘পরিবহণ দফতর আর পুলিশ চাইলেই ভুল রুটে ট্রাক ঢোকা পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে পারে। করে না বলেই এত বড় সর্বনাশ হল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy