Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
নাগরিক মন্দির

কংক্রিটের আড়ালে মুখ ঢেকেছে মন্দিরশিল্প

কেমন আছে দক্ষিণ কলকাতার সেই মন্দিরটি যার স্থাপত্য শৈলীর অনুকরণে তৈরি হয়ে ছিল দক্ষিণেশ্বরের মন্দির। কিংবা মঙ্গলকাব্যে এ শহরের যে সমস্ত মন্দিরের উল্লেখ আছে তারা? খুঁজে দেখলেন বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্যকলকাতা মন্দিরের শহর নয়। সে তকমা অন্য এক শহরের নামের পাশে জ্বলজ্বল করে। আমাদের এই শহর তো ‘সিটি অব জয়’। অনেকে আবার সম্ভ্রম করে একে ‘সিটি অব প্যালেস’ও বলেন। কিন্তু, ‘সিটি অব টেম্পল’ না হওয়া সত্ত্বেও এ শহরের অলিতে গলিতে আজও দেখা যায় এমন কিছু মন্দির, যার গঠন শৈলী আর স্থাপত্য-বৈচিত্র নজর কাড়ে। অথচ কলকাতার ‘মাস্ট সিন’ তালিকা হোক বা গাইড বই— কোথাও এই সব মন্দিরের উল্লেখ মেলে না। সদ্য পেরিয়ে আসা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ দিবসে যখন শহরের ঐতিহ্য নিয়ে এত হইচই, তখনও অবহেলার আঁধারে রয়ে গেল এই সব মন্দিরের বেশির ভাগই।

চেতলায় রাধাকান্ত জিউয়ের মন্দির।

চেতলায় রাধাকান্ত জিউয়ের মন্দির।

শেষ আপডেট: ২০ মে ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

কলকাতা মন্দিরের শহর নয়। সে তকমা অন্য এক শহরের নামের পাশে জ্বলজ্বল করে। আমাদের এই শহর তো ‘সিটি অব জয়’। অনেকে আবার সম্ভ্রম করে একে ‘সিটি অব প্যালেস’ও বলেন। কিন্তু, ‘সিটি অব টেম্পল’ না হওয়া সত্ত্বেও এ শহরের অলিতে গলিতে আজও দেখা যায় এমন কিছু মন্দির, যার গঠন শৈলী আর স্থাপত্য-বৈচিত্র নজর কাড়ে। অথচ কলকাতার ‘মাস্ট সিন’ তালিকা হোক বা গাইড বই— কোথাও এই সব মন্দিরের উল্লেখ মেলে না। সদ্য পেরিয়ে আসা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ দিবসে যখন শহরের ঐতিহ্য নিয়ে এত হইচই, তখনও অবহেলার আঁধারে রয়ে গেল এই সব মন্দিরের বেশির ভাগই।

তবু ঠিকানা জোগাড় করে, ক্যামেরা হাতে মাঝে মাঝেই সে সব জায়গায় ভিড় করেন বিদেশিরা। অতি আগ্রহে ছবিও তোলেন। কিংবদন্তির পাশাপাশি জেনে নিতে চান অজানা ইতিহাস। বাঙালির স্মৃতিতে কলকাতার মন্দির হিসেবে উজ্জ্বল দক্ষিণেশ্বর কিংবা কালীঘাটের মতো কয়েকটি জায়গা। অথচ বিস্মৃতির অন্তরালে ঢাকা পড়েছে এ শহরের ব্যতিক্রমী কিছু মন্দির।

কলকাতার মন্দিরগুলিকে মূলত নবরত্ন, পঞ্চরত্ন, আটচালা, দোচালা এবং দালান রীতিতে ভাগ করেছেন গবেষকরা। এগুলির মধ্যে আকারে উপর নির্ভর করে তাদের স্থাপত্য বৈচিত্র এবং গুরুত্ব।

খাস দক্ষিণ কলকাতার চেতলা রোডে রয়েছে এমন একটি নবরত্ন মন্দির, সম্ভবত যার আদলে তৈরি হয়েছিল দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির। এমনটাই লিখেছিলেন গবেষক তারাপদ সাঁতরা। শোনা যায়, রানি রাসমণি ম্যাকিনটস বার্ন কোম্পানিকে মন্দির তৈরির জন্য ঠিকাদারির দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ম্যাকিনটস বার্ন কোম্পানি সেই সময় চেতলার নবরত্ন মন্দিরটির অনুরূপ স্থানীয় সূত্রধর ও কারিগরদের সহযোগিতায় দক্ষিণেশ্বরে মন্দিরটি তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন।

চেতলা রোডে রাধাকান্তের সেই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রামনাথ মণ্ডল। মন্দিরের নির্মাণ কাল ১৭৯৬। যদিও মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৮০৯-এ। নবরত্ন এই মন্দিরের সামনে রয়েছে থামযুক্ত বড় নাটমন্দির। চার পাশে বহুতল বাড়ি ও নির্মিয়মাণ বহুতলে ঢাকা পড়েছে মন্দিরের অনেকটাই।

তেমনই টালিগঞ্জ রোডের মণ্ডল পরিবারের জোড়া পঞ্চরত্ন মন্দিরের মাঝে ১৮৪৫-এ প্রতিষ্ঠিত গোপাল জিউর নবরত্ন মন্দিরে স্থাপত্যের বিশেষত্ব রয়েছে। থাম ও কার্নিশযুক্ত প্রবেশ পথ পেরিয়ে মন্দির প্রাঙ্গণে দেখা যায় মলিন হয়ে আসা সাদা-কালো পাথর বসানো উঠোন। উঠোন পেরিয়ে থামযুক্ত দালান এবং এই দালানই চকমেলানো চত্বরের আকার নিয়েছে। দালানের ডান এবং বাঁ দিকে রয়েছে বেশ কিছু শিবমন্দির।

কুমোরটুলি অঞ্চলে সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের বিপরীতে একটি নবরত্ন মন্দির দেখা যায়। এটি গোবিন্দরাম মিত্র প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত সেই মন্দিরের টিকে থাকা অংশ। চার্লস ড’য়লি, টমাস ড্যানিয়েল, টমাস প্রিন্সেপ প্রমুখ শিল্পীদের আঁকা ছবি দেখলে মন্দিরের আসল চেহারা কেমন ছিল সে সম্পর্কে একটা ধারণা জন্মায়।

উনিশ শতকে কলকাতায় যে দু’টি নবরত্ন মন্দির তৈরি হয়েছিল, তার মধ্যে একটি ১৮৬৫-তে ঈশ্বরচন্দ্র নান প্রতিষ্ঠিত নিস্তারিণী কালীমন্দির। নবরত্ন কালীমন্দিরটির দু’পাশে রয়েছে দু’টি আটচালা শিবমন্দির। অন্য নবরত্ন মন্দিরটি হল শ্যামপুকুর এলাকায় বলরাম ঘোষ স্ট্রিটের ভবতারিণী কালীমন্দির। ১৮৮৮তে এটির প্রতিষ্ঠা করেন দয়াময়ীদেবী। এখানেও দু’পাশে দেখা যায় হরেশ্বর ও হরপ্রসন্ন নামক দু’টি শিব মন্দির।

ব্যারাকপুরের তালপুকুরে ১৮৭৫-এ রানি রাসমণির মেয়ে জগদম্বা দেবী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অন্নপূর্ণা মন্দির। দেখতে দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের মতো হলেও এই মন্দির উচ্চতায় কিছুটা বড় এবং দৈর্ঘ্য-প্রস্থে কিছুটা কম। তা ছাড়া এখানে রয়েছে ছ’টি শিবমন্দির।

বিংশ শতাব্দীতেও কলকাতায় তৈরি হয়েছিল নবরত্ন মন্দির। বিশ শতকের গোড়ার দিকে কেওড়াতলা শ্মশানে তৈরি হয়েছিল ময়মনসিংহের জমিদার পরিবারের এক নবরত্ন শিবমন্দির। পরে ১৯২২-এ বাবু রাম ঘোষ স্ট্রিটে তৈরি হয়েছিল উমাসুন্দরী কালীর নবরত্ন মন্দির।

গোবিন্দরাম মিত্রের নবরত্ন মন্দির

আগে।

এখন।

নবরত্ন ছাড়াও এ শহরে রয়েছে বেশ কিছু আটচালা মন্দির। এর মধ্যে কিছু মন্দির আকারে বড়। অষ্টাদশ শতকে এই শহরে যে ক’টি বৃহত্‌ আটচালা মন্দির তৈরি হয়েছে তাঁর মধ্যে অন্যতম মন্দির শোভাবাজারের নন্দরাম সেনের আটচালা মন্দির। রামেশ্বর শিবমন্দিরের চালটি বাঁকানো এবং তিন খিলানের স্থাপত্য বিশেষ। মন্দিরের প্রতিষ্ঠালিপিতে উল্লেখ করা আছে ‘সন ১০৬১ তাং ৩০ চৈত্র’। তবে, এই প্রসঙ্গে তারাপদ সাঁতরা উল্লেখ করেছেন মন্দিরের প্রতিষ্ঠা সাল ১৭৩৯। আগে মন্দিরের প্রতিষ্ঠা লিপিতে শকাব্দ উল্লেখ করা হত। পরবর্তী কালে বঙ্গাব্দ উল্লেখ করার প্রচলন হয়। প্রখ্যাত বিদেশি শিল্পী থমাস ও উইলিয়াম ড্যানিয়েল্স-এর আঁকা চিত্‌পুর রোডের একটি ছবিতে এই মন্দিরটি ধরা পড়েছে। শোভাবাজার বাজারের উল্টো দিকের নন্দরাম সেন স্ট্রিটের এই মন্দিরটি প্রায় ঢাকাই পড়েছে বিক্ষিপ্ত ভাবে গড়ে ওঠা বহুতল এবং বৈদ্যুতিক পোস্ট এবং তারে।

দক্ষিণ কলকাতাতেও রয়েছে কয়েকটি বড় আটচালা মন্দির। টালিগঞ্জ রোডে বড়রাস বাড়ি বলে পরিচিত মন্দিরটি রাধা-মদনমোহনের। ১৮৩৪-এ এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন বাওয়ালির জমিদার উদয়নারায়ণ মণ্ডল। প্রথাগত আটচালা শৈলীর এই মন্দিরটি তিন খিলানযুক্ত বাঁকানো চালের। মন্দিরের সামনে বড় নাটমন্দির। রাস উত্‌সবের সময় আজও বহু মানুষের ভিড় হয়। ওই একই রাস্তায় একটু এগিয়ে গেলে বিগত যুগের প্রখ্যাত যাত্রা অভিনেতা মথুর শা-র প্রতিষ্ঠিত লক্ষ্মী-নারায়ণ ও শ্রীধর জিউর মন্দির রয়েছে। যদিও বাইরে থেকে এই মন্দিরটি ভাল ভাবে দেখা যায় না। কারণ পুরনো এই মন্দিরের বর্তমান অবস্থান একটি বহুতল আবাসনের মধ্যে।

খিদিরপুর ভূকৈলাশ রাজবাড়িতেও দেখা যায় দু’টি বৃহত্‌ আকারের শিব মন্দির। ১৭৮০-তে রক্তকলমেশ্বর ও কৃষ্ণচন্দ্রেশ্বরের দু’টি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জয়নারায়ণ ঘোষাল।

কলকাতার মন্দির-বৈচিত্র সবচেয়ে বেশি দেখা যায় দালান রীতির মন্দিরে। তা সে চকমেলানো দালান হোক বা পৃথক একক দালান। শোভাবাজার রাজপরিবারের গোবিন্দ জিউ বা গোপিনাথ জিউর দালানমন্দির থেকে শুরু করে খিদিরপুরের ভূকৈলাশ রাজবাড়ির পতিতপাবনী দুর্গামন্দির— দালান-শৈলীর অসংখ্য উদহরণ দেখা যায় এ শহরে।

বাংলার মঙ্গলকাব্যে উল্লেখ রয়েছে কলকাতার এমন দু’টি প্রাচীন মন্দিরও দালান রীতির। সে দু’টি— চিত্‌পুর খগেন চ্যাটার্জি রোডের আদি চিত্তেশ্বরী মন্দির ও চিত্তেশ্বরী সর্ব্বমঙ্গলা মন্দির। আদি চিত্তেশ্বরী মন্দিরে দেখা যায় কিছু কিছু পঙ্খের কাজ। তা ছাড়া পেডিমেন্ট-সহ কোরিন্থিয়ান থাম। মন্দিরের প্রতিষ্ঠালিপিতে উল্লেখ করা আছে ১৬১০-এর কথা। তবু এর প্রাচীনত্ব নিয়ে মতান্তর রয়েছে। বর্তমান মন্দির, দালান, নাটমন্দির ও নহবত্‌খানায় বহু বার সংস্কারের ফলে সাবেক রূপটি আর বোঝা যায় না। এই মন্দিরের অদূরেই রয়েছে চিত্তেশ্বরী সর্বমঙ্গলার মন্দির। এটিও দালান রীতির। এই মন্দিরটি নিয়ে কিংবদন্তি রয়েছে। মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত দেবী নাকি আগে দক্ষিণমুখী ছিলেন। এক দিন সাধক-কবি রামপ্রসাদ সেন নৌকায় গান গাইতে গাইতে যাচ্ছিলেন। তাঁর গান শোনার জন্য দেবী নাকি পশ্চিমমুখী হয়েছিলেন।

তবে এ শহরে সব চেয়ে কম দেখা যায় দোচালা মন্দির। বাগবাজারের জগত্‌রাম হালদারের দোচালা মন্দিরটি সেই শৈলীর টিকে থাকা একটি নমুনা। তারাপদ সাঁতরার মতে মন্দিরটির নির্মাণ কাল আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়। মন্দিরের প্রবেশ পথে নতুন সংযোজন লক্ষনীয়।

তবে উল্লেখিত এই কয়েকটি মন্দির ছাড়াও কলকাতায় রয়েছে অসংখ্য পুরনো মন্দির।

ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য ও নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE