Advertisement
১৮ মে ২০২৪

ভাঙচুর, ধরপাকড়েও টনক নড়ে কই

ঠেকেও শিক্ষা হয় না।তমলুক, ময়নায় চোলাই খেয়ে মৃত্যুমিছিলের পরেও হুঁশ ফেরেনি। খেজুরি গ্রামে রমরমিয়ে চলত চোলাই ঠেক। ফল, গত কয়েকদিনের মৃত্যু মিছিল।

বেআইনি মদ উদ্ধারে তল্লাশি পুলিশের। —নিজস্ব চিত্র।

বেআইনি মদ উদ্ধারে তল্লাশি পুলিশের। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৬ ০২:২৪
Share: Save:

ঠেকেও শিক্ষা হয় না।

তমলুক, ময়নায় চোলাই খেয়ে মৃত্যুমিছিলের পরেও হুঁশ ফেরেনি। খেজুরি গ্রামে রমরমিয়ে চলত চোলাই ঠেক। ফল, গত কয়েকদিনের মৃত্যু মিছিল। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসন সব জেনেও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি, ঠুঁটো আবগারি দফতর। নামমাত্র তল্লাশি চালিয়েই তাদের দায়িত্বে শেষ।

তবে এ বার বেআইনি মদের বিরুদ্ধে নাগরিক সচেতনতা গড়তে অভিযান শুরু করেছে খেজুরি-২ পঞ্চায়েত সমিতি ও খেজুরি গ্রামপঞ্চায়েত। সাধারণ মানুষের কাছে গিয়ে বেআইনি মদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে প্রচার চালাচ্ছেন পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি অসীম মণ্ডল, স্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ ছবি বারুই ও খেজুরি গ্রামপঞ্চায়েত প্রধান রেহানা খাতুন।

চোলাই খেয়ে ছ’জনের মৃত্যুর পর শনিবার থেকেই মদ বিরোধী জনমত গড়ে তোলার অভিযানের সূত্রপাত। খেজুরি-২ পঞ্চায়েত সমিতির স্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ ছবি বারুই জানিয়েছেন, নতুন করে আর মৃতের সংখ্যা বাড়েনি। তমলুক জেলা হাসপাতালে ভর্তি হওয়া অসুস্থদের অধিকাংশকেও ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শনিবার সকাল থেকেই খেজুরি গ্রাম পঞ্চায়েতের বটতলা ও আশপাশের এলাকাগুলিতে স্থানীয় বাসিন্দারা চোলাই মদের ঠেকগুলিতে ভাঙচুর করেন। বেশ কয়েকজন মদ বিক্রেতাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ।

শনিবার রাতে নতুন করে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটলেও সারারাত এলাকাজুড়ে পুলিশি টহল চলেছে বলে কাঁথির এসডিপিও ইন্দিরা মুখোপাধায় জানিয়েছেন। শনিবারই খেজুরি ও তালপাটি থানার পুলিশ অভিযান চালিয়ে দুই মহিলা-সহ সাত জন চোলাই বিক্রেতাকে গ্রেফতার করে। বাজেয়াপ্ত করা হয় দেড়শো লিটারের বেশি বেআইনি মদ। জেলা পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়ার নির্দেশে শনিবার জেলার অন্যান্য থানা এলাকাতেও বিশেষ পুলিশি অভিযান চালানো হয়েছে। আবগারি দফতর ও পুলিশের যৌথ অভিযানে চণ্ডীপুর থানার বরাহচণ্ডী গ্রাম থেকে কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাজেয়াপ্ত হয়েছে চোলাই তৈরির কাঁচামালও। পুলিশ সুপার রবিবার বলেন, ‘‘চোলাই মদ তৈরি ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে খেজুরি, চণ্ডীপুর-সহ জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে এখনও পর্যন্ত মোট ৩০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’’

খেজুরি গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য রাধারানি জানার স্বামী রবি জানার মৃত্যু হয় শনিবার সকালে। ময়না তদন্তের পর শনিবার গভীর রাতে তাঁকে দাহ করা হয়। খেজুরি-২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি অসীম মণ্ডল বলেন, ‘‘২৮ জুন থেকে খেজুরিতে বেশ কিছু মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েন। পাঁচ জনের মৃত্যু হয়। কিন্তু কাউকে কিছু না জানিয়েই মৃতদেহ দাহ করে ফেলেন পরিবারের লোকেরা।’’ ফলে কোনও অভিযোগ হয়নি। পঞ্চায়েত সমিতিই উদ্যোগী হয়ে শুক্রবার ১৮ জনকে জেলা হাসপাতালে পাঠায়। শনিবার রবি জানার মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর খবর আসতেই বাসিন্দারা, বিশেষ করে মহিলারা এলাকার বেআইনি মদের দোকানগুলিতে ভাঙচুর শুরু করেন। তাঁদের অভিযোগ, আবগারি দফরতের মদতেই রমরমিয়ে চলে এই সব মদের দোকানগুলি। নিম্নবিত্ত শ্রমিক শ্রেণির মানুষ, গ্রামের অল্পবয়সী ছেলেছোকরা থেকে রাজনৈতিক কর্মী কেউ বাদ পড়েন না ঠেকে আড্ডায়। প্রশাসনের সঙ্গে মাসিক বন্দোবস্ত করেই ব্যবসা চালে রমরমিয়ে। গ্রামপ্রধান রেহানা খাতুন, খেজুরি-২ পঞ্চায়েত সমিতির নারী শিশুকল্যাণ কর্মাধ্যক্ষ সুতৃষ্ণা প্রামাণিকের কথায়, “পুরুষদের বুঝিয়ে কাজ হয় না। তাই আমরাই এগিয়ে এসেছি। আবার মাদ বিক্রি করলে আবার ভেঙে দেব।’’

তবে ইতিহাস বলছে, এমনটা এর আগে বহুবার হয়েছে। ২০০৯ সালের মে মাস নাগাদ তমলুক থানার শহিদ মাতঙ্গিনী ব্লকের কাঁকটিয়া বাজার ও রামতারক বাজার এলাকায় চোলাই খেয়ে ৫২ জন গ্রামবাসীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। অসুস্থ হয়ে দৃষ্টিশক্তি হারান বেশ কয়েকজন। গত সেপ্টেম্বর মাসে জেলারই ময়না থানার আড়ংকিয়ারানা বাজার এলাকায় চোলাই মদের ঠেকে মদ খেয়ে মৃত্যু হয় ২৫ জন গ্রামবাসীর। ওই ঘটনার পর বিভিন্ন এলাকায় তল্লাশি চালানো হয়। তারপরেও অবস্থার যে কোনও পরিবর্তন হয়নি তার প্রমাণ মিলল খেজুরিতে।

শুধু খেজুরি নয়, জেলার তমলুক থানা এলাকার কুরপাই, নোনাকুড়ি বাজার, মিলননগর বাজার, ডিমারি বাজার, কোলাঘাট থানার মেচেদা বাজার, বুড়ারি বাজার, নন্দকুমার থানার মহম্মদপুর, কালীরবাজার এলাকায় এখনও চোলাইয়ের ঠেক চলছে। এ ছাড়াও চণ্ডীপুর, পাঁশকুড়ার বিভিন্ন এলাকাতেও চোলাই ব্যবসায় রাশ টানা যায়নি। স্থানীয়দের অভিযোগ, আবগারি দফতর ও পুলিশ মাঝেমামধ্যে চোলাই ঠেকগুলিতে হানা দিয়ে বেআইনি মদ বাজেয়াপ্ত করে। চোলাই ব্যবসায়ীদেরও গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ফের ঠেক খুলে যায় বলে অভিযোগ।

জেলা পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া অবশ্য বলেন, ‘‘ময়নার ঘটনায় অভিযুক্ত সব চোলাই ব্যবসায়ীরা এখন জেল হেফাজতে রয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে আদালতে নির্দিষ্ট সময়ে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে।’’

কিন্তু তারপর? চাপা কান্না গুমরে মরে মৃতদের অসহায় পরিবারে। (তথ্য: সুব্রত গুহ ও আনন্দ মণ্ডল)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Vandalism Police
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE