Advertisement
০২ মে ২০২৪
শাসক যার, মুলুক তার

বন্দরের জমি সেই ভেঙ্কটেশের কব্জায়

শাসক দল পাশে থাকলে কার্যত যা খুশি তা-ই করা যায়, সেটা বারবার দেখেছে এ রাজ্য। দেখেছে, পুলিশ কী ভাবে ঠুঁটো হয়ে থাকে। রবিবারের সকালে আরও এক বার সেই ছবিটাই দেখল তারাতলার হাইড রোড।

তখনও আসেনি গুন্ডাবাহিনী। জমির দখল নেওয়ার পরে পোর্ট ট্রাস্টের নিরাপত্তা রক্ষীরা। রবিবার সকালে শুভাশিস ভট্টাচার্য়ের তোলা ছবি।

তখনও আসেনি গুন্ডাবাহিনী। জমির দখল নেওয়ার পরে পোর্ট ট্রাস্টের নিরাপত্তা রক্ষীরা। রবিবার সকালে শুভাশিস ভট্টাচার্য়ের তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৩৫
Share: Save:

শাসক দল পাশে থাকলে কার্যত যা খুশি তা-ই করা যায়, সেটা বারবার দেখেছে এ রাজ্য। দেখেছে, পুলিশ কী ভাবে ঠুঁটো হয়ে থাকে। রবিবারের সকালে আরও এক বার সেই ছবিটাই দেখল তারাতলার হাইড রোড।

বেদখল হয়ে যাওয়া জমি আইন মেনে নিজের দখলে নিতে গিয়েছিল বন্দর কর্তৃপক্ষ। নিয়েওছিল। নোটিস সেঁটে পুলিশকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু এক ঘণ্টার মধ্যেই দিনের আলোয় দুষ্কৃতী বাহিনী আসরে নামল। জমির ফের দখল নিল। সাংবাদিকদের মাটিতে ফেলে বেধড়ক পেটাল। পুলিশ কিছু করল না।

কেন? বিরোধী দল থেকে শুরু করে ঘটনাটি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল সব পক্ষই একটাই কথা বলছেন। যে প্রযোজনা সংস্থা জমিটি বেদখল করে বলে অভিযোগ, সেই ভেঙ্কটেশ ফিল্মস-এর কর্ণধার শ্রীকান্ত মোহতা শাসক দলের বিশেষ ঘনিষ্ঠ। তাই সাত খুন মাফ। অভিযোগ, এই শ্রীকান্তকেই এর আগে লেক মলের ‘লিজ’ পাইয়ে দিতে রাজ্যের ২৪ কোটি টাকা রাজস্ব লোকসান করেও বেআইনি সুবিধা দিয়েছিল পুরসভা। কর ফাঁকির অভিযোগে শ্রীকান্তর অফিসে তল্লাশি চালাতে গিয়ে নবান্নের ফোনে হাত গোটাতে বাধ্য হয়েছিলেন বাণিজ্য-কর বিভাগের কর্তারা। এই শ্রীকান্তই শাসক দলের মিছিলে-সমাবেশে টলিউডি তারকাদের চাঁদের হাট বসানোর দায়িত্বে থাকেন। সিঙ্গাপুর ও লন্ডনে মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গী এই সিনেমা ব্যবসায়ী এখন রাজ্য তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের প্রচার কমিটির উপদেষ্টাও বটে।

অতএব? কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষ এ দিন সাতসকালে তাঁদের জমির দখল নিতে পুলিশি সহায়তা চেয়েছিলেন। পুলিশ যায়নি। নিজ উদ্যোগে জমির দখল নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ সে কথা তারাতলা থানায় জানিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার অনুরোধ করেছিলেন। পুলিশ সেই চিঠি গ্রহণ করেছিল। কিন্তু তার এক ঘণ্টা পর থেকে ওই জমির আশপাশে লাঠিসোটা নিয়ে লোকজনের জমায়েত শুরু হয়। পুলিশ যায়নি। যত ক্ষণে তাদের ঘটনাস্থলে দেখা গেল, তার মধ্যে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের বেদম মারধর করা হয়েছে। পি-৫১ তারাতলা হাইড রোড এক্সটেনশন থেকে পোর্ট ট্রাস্টের নিরাপত্তারক্ষীদের বের করে দিয়ে কয়েকশো দুষ্কৃতী ফের তা জবরদখল করেছে।

রবিবার সকালে পি-৫১-র দরজায় পোর্ট ট্রাস্টের তরফে সেঁটে দেওয়া সেই নোটিস।
পরে যা ছিঁড়ে নেয় দুষ্কৃতীরা। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।

মগের মুলুককে হার মানানো এমন ঘটনায় পুলিশ এতটা নিষ্ক্রিয় থাকল কী ভাবে? লালবাজারের আর এক কর্তা বললেন, ‘‘সবই তো বোঝেন। বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীর লড়াই। আমরা কোন দিকে থাকব, আমাদের কোন দিকে থাকাটা বাধ্যতামূলক, সেটা কি আর বলে দিতে হবে?’’

ওই কর্তার কথা থেকেই একটা বিষয় পরিষ্কার— তারাতলায় এ দিন যা হল, সেটা এ রাজ্যের চলতি ধারাতেই আর একটি সংযোজন। হলদিয়ায় এর আগে শাসক দলের গুন্ডামির মুখে রাজ্য ছেড়ে যেতে হয়েছিল এবিজি-কে। প্রকাশ্যে ‘পায়ের তল দিয়ে’ তিন জনকে খুন করার কথা স্বীকার করেও পার পেয়ে যান শাসক দলের বিধায়ক মনিরুল ইসলাম। পুলিশকে বোম মারতে বলে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ান অনুব্রত মণ্ডল। রেপ করানোর হুমকি দিয়ে ছাড় পান সাংসদ তাপস পাল। পুলিশের চোখের উপর দিয়েই শাসক দলের মদতপুষ্ট সিন্ডিকেট আর তোলাবাজির কবলে পড়ে একের পর এক সংস্থা। আবার শাসক দল চাইলে এই পুলিশই ব্যঙ্গচিত্র মেল করার দায়ে অধ্যাপককে গ্রেফতার করে। মুখ্যমন্ত্রী মাওবাদী বলে দেগে দিলে ধরে আনা হয় নিরীহ কৃষককে। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু তাই এ দিন বলছেন, ‘‘তারাতলায় ঘটনা তো কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তৃণমূলের কাছের লোক হলে যা হওয়ার থাকে, তা-ই হয়েছে। ‘রায়গঞ্জে জেল আর মাজদিয়ায় বেল’, এই প্রবণতাই তো এ জমানার নিয়ম!’’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীরও মতে, ‘‘রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে আর পুলিশ কী ভাবে দলদাসে পরিণত হয়েছে, সেটাই বারবার প্রমাণিত হচ্ছে!’’

পুলিশেরই একটি সূত্রের খবর— জমির দখল নিতে সাহায্য চেয়েও না পাওয়া, জমি দখলমুক্ত হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গুন্ডা পাঠিয়ে ফের জবরদখল, খবর পেয়েও পুলিশের না পৌঁছনো এবং শেষমেশ সাংবাদিক-চিত্রসাংবাদিকদের প্রহার— পরপর এই ঘটনাপ্রবাহে সুপরিকল্পিত পদক্ষেপের ছাপ আছে এবং এর পিছনে বড়সড় রাজনৈতিক মাথা কাজ করেছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ (কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট) যে জমির দখল নিতে যাবেন— এই খবর আগে থেকেই কোনও ভাবে ফাঁস হয়ে গিয়ে থাকবে। একটি সূত্রের খবর, অবস্থা আগাম আঁচ করে শনিবার রাত থেকেই ওই তল্লাটে জড়ো করা হয়েছিল দুষ্কৃতীদের, যাদের একাংশ আবার বহিরাগত। এবং পুলিশের একটি অংশ এই ব্যাপারে অবগত ছিলেন। এলাকার রাজনৈতিক সূত্রের খবর, জমি দখল এবং হাঙ্গামার ঘটনায় রাজ্যের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ, বন্দর এলাকার কাউন্সিলর আনোয়ার খানের দলবলকে এ দিন দেখা গিয়েছে। যদিও আনোয়ার খান দাবি করেছেন, ‘‘ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের সঙ্গে আমার কোনও যোগ নেই। বন্দর এবং ওই সংস্থার মধ্যে গোলমালে আমি জড়িত নই।’’ পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ববি হাকিমের দাবি, ‘‘পুলিশ যাওয়ার পরে আনোয়ার গিয়েছিল। গুন্ডামি কারা করেছে জানি না। হতে পারে ওদের (ভেঙ্কটেশ) নিজেদের লোক ছিল!’’

বন্দরকর্তাদের বক্তব্য, জমি পুনরুদ্ধারের আইনি অনুমোদন যে তাঁদের রয়েছে, তার প্রমাণ পুলিশের কাছে পেশ করা হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ বিভিন্ন অজুহাতে ওই জমি জবরদখলমুক্ত করার অভিযানে সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছিল। এই নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে মামলাও চলছে। রবিবার ভোরেও পি ৫১ হাইড রোড এক্সটেনশনের জমি দখলের জন্য লিখিত ভাবে পুলিশের সাহায্য চাওয়া হয়েছিল। মেলেনি। পরে বিচারাধীন মামলার যুক্তি দেখিয়েই নিজেদের বাহিনী না পাঠানোর যুক্তি দেন লালবাজারের এক কর্তা। কিন্তু বন্দর কর্তারা বলছেন, ‘পাবলিক প্রেমিসেস অ্যাক্ট’ মেনে বন্দরকে বাহিনী দিয়ে সাহায্য করতেই পারত লালবাজার। কিন্তু ঘটনার সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী জুড়ে থাকায় লালবাজার বাহিনী পাঠায়নি বলে অভিযোগ। শেষ পর্যন্ত নিজেদের নিরাপত্তারক্ষীদের দিয়েই জমিটি দখল করেন বন্দর কর্তৃপক্ষ। ভোর ৬টা ৩৫ থেকে অভিযান শুরু করে ৭টার মধ্যে তা শেষ হয়। সরকারি নোটিস লটকে দেওয়া হয় ওই জমির স্টুডিওয়। তার পর তারাতলা থানাকে সেই খবর লিখিত ভাবে জানিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার আর্জি জানানো হয়।

কেপিটি-র (কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট) দাবি, এর পর ওই জমির জবরদখলদার তথা শ্রীকান্ত মোহতার ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের কর্মীরা এবং একটি মস্তান বাহিনী জমি ফের দখল করতে নামে। সেই সময়ে পুলিশের সাহায্য চাইলেও বাহিনী পৌঁছয়নি। বন্দরের এক কর্তা জানান, জমি দখলের পর ভিতরে ক্যাম্প অফিস তৈরির কাজ চলছিল। মূল গেট বন্ধ ছিল। ভিতরে ছিলেন কেপিটি-র জনা ৩০ নিরাপত্তারক্ষী। সকাল আটটা থেকে গেটের বাইরে লোক জমতে শুরু করে। কেপিটি-র তরফে পুলিশকে জানানো হলেও পুলিশ আসেনি বলে অভিযোগ। ১০টা নাগাদ কয়েকশো গুন্ডা পাঁচিল টপকে ভিতরে ঢোকে। পোর্ট ট্রাস্টের এস্টেট ম্যানেজার শুভ্রকমল ধর পরে বলেন, ওই গুন্ডারা সদর দরজায় লাগানো তালা ভেঙে বাইরে থেকে আরও লোকজন ঢোকায়। বন্দরের নিরাপত্তারক্ষীরা রুখে দাঁড়ালেন না কেন? শুভ্রকমলবাবুর কথায়, ‘‘কয়েকশো লোককে মোকাবিলা করার ক্ষমতা অল্পসংখ্যক নিরাপত্তাকর্মীর ছিল না। পাঁচিল টপকে গুন্ডারা ঢুকে পড়বে, এমনটা আগে থেকে ভাবা যায়নি।’’ নিজের হতাশা গোপন না করে তাঁর বক্তব্য, ‘‘ভারত সরকারের একটি স্বশাসিত সংস্থা তাদের বেদখল হয়ে যাওয়া জমি উদ্ধারের জন্য কলকাতা পুলিশের সাহায্য চেয়েও পেল না। ওই জমি ফের দখল হওয়ার পরেও পুলিশকে জানিয়ে কোনও কাজ হল না।’’ বিজেপি রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের অভিযোগ, ‘‘এই ঘটনা সরকার, গুন্ডাবাহিনী ও অসাধু ব্যবসায়ীর মধ্যে আঁতাঁতটা স্পষ্ট করে দিল।’’

সরকারি ভাবে কী বলছেন লালবাজারের কর্তারা? কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্রর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, ‘‘কী ঘটেছে, কেন ঘটেছে, পুরোটাই আমরা খতিয়ে দেখছি।’’ বন্দরের জমি নতুন করে জবরদখল এবং সাংবাদিকদের প্রহার— দু’টি পৃথক মামলা রুজু হলেও রবিবার রাত পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। এত বড় হাঙ্গামার পরেও ঘটনাস্থলে যাননি কলকাতা পুলিশের সংশ্লিষ্ট বিভাগের ডিসি কিংবা কোনও উপরতলার কর্তা। রাতে জমিটির সাব-লিজ হোল্ডার এলএমজি কনস্ট্রাকশন সংস্থা বন্দর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে পাল্টা একটি অভিযোগ দায়ের করেছে। ভেঙ্কটেশের কর্ণধার শ্রীকান্ত মোহতা লিখিত ভাবে কোনও বিবৃতি না দিলেও সংবাদমাধ্যমের একাংশের কাছে ফোন করে সাংবাদিক নিগ্রহের ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তাঁর দাবি, ‘‘কিছু টেকনিশিয়ান উত্তেজনার বশে ঘটনাটা ঘটিয়ে বসেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE