Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

বিজ্ঞান পড়তেই হবে, নাছোড় ছেলে খাটতে গেল কারখানায়

ছুতোর মিস্ত্রির কাজ করে দিনের শেষে আয় বলতে সাকুল্যে দু’শো টাকা। তাতে চার জনের সংসারে বড় টানাটানি। এর মধ্যেও বড় ছেলেটা নাছোড়, পড়াশোনা সে করবেই।

সেলাই মেশিনে ব্যস্ত সুমন্ত। — নিজস্ব চিত্র

সেলাই মেশিনে ব্যস্ত সুমন্ত। — নিজস্ব চিত্র

কল্লোল প্রামাণিক
করিমপুর শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৬ ০২:১৩
Share: Save:

ছুতোর মিস্ত্রির কাজ করে দিনের শেষে আয় বলতে সাকুল্যে দু’শো টাকা। তাতে চার জনের সংসারে বড় টানাটানি। এর মধ্যেও বড় ছেলেটা নাছোড়, পড়াশোনা সে করবেই।

কোনও দিনই আপত্তি ছিল না সত্য মিস্ত্রির। তবে কি না এ-ও তো সত্যি, সংগতি তাঁর নেই। যদিও ছেলে এ নিয়ে কখনও টুঁ শব্দটি বলেনি। কখনও মুখ ফুটে সামান্য কিছু আব্দার করেনি পর্যন্ত। এর-ওর পুরনো বই চেয়েচিন্তে পড়াশোনা করেছে।

তবু এ বার যেন কিছুটা খচখচই করছে সত্যবাবুর। ছেলে যে একেবারে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। করিমপুর জগন্নাথ উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র সুমন্ত মাধ্যমিকে ৬২৯ পেয়েছে। বাংলায় ৮৫, ইংরাজিতে ৮৬, অঙ্কে ১০০, ভৌতবিজ্ঞানে ৯১, জীবনবিজ্ঞানে ৯৪, ইতিহাসে ৮৩, ভূগোলে ৯০, সবেতে লেটার মার্কস। এমন মেধাবী ছেলেটাকে কি না উচ্চমাধ্যমিক পড়ার জন্য কারখানায় যেতে হচ্ছে! সত্যবাবুর মনটা সত্যিই খারাপ।

আসলে বরাবরই বিজ্ঞানের প্রতি ঝোঁক রয়েছে সুমন্তর। ভেবেছিল এগারো-বারো ক্লাসে বিজ্ঞান নিয়ে পড়বে। কিন্তু সে শুনেছে, ও নিয়ে পড়ার অনেক খরচ। তা ছাড়া গৃহশিক্ষক না থাকলে ভাল ফল করা অসম্ভব। তাই মাধ্যমিকটা শেষ হতেই সে ঢুকে গিয়েছে একটা ব্যাগ তৈরির কারখানায়। সকাল-বিকেল সেখানে কাজ করে। নিজের পরিশ্রমের টাকায় ইতিমধ্যেই গৃহশিক্ষকের কাছে পড়া শুরু করে দিয়েছে।

এ দিন সুমন্তদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, সত্যবাবু রোজকার মতো কাজে বেরিয়ে গিয়েছেন। টালির ঘর। অভাবের ছাপ বাড়ির আনাচেকানাচে। ঘরে ছিল সুমন্ত, তার বছর পাঁচেকের ছোট ভাই ও মা। সুমন্তর মা অমিতাদেবী বললেন, “ওর বাবার সামান্য আয়। তাই দিয়ে কোনও মতে সংসার চলে। পড়াশোনার খরচ চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়।’’ তিনি জানালেন, মঙ্গলবার সুমন্তর বন্ধুরা সবাই ইন্টারনেটে পরীক্ষার ফল দেখেছে। কিন্তু সেখানে দশ টাকা লাগবে বলে যায়নি সুমন্ত। পরে পাড়ার এক দাদা মোবাইল থেকে জানিয়ে দেয়। ‘‘আমরা ওকে কিছুই দিতে পারি না। ওর নিজের জেদেই মাধ্যমিক পাশ করলো। আর কত দিন এ লড়াই চালিয়ে যেতে পারবে, জানি না,” বললেন তিনি।

মায়ের কথা শুনে মাথা নিচু করে বসেছিল সুমন্ত। প্রশ্ন করতেই বলল, ‘‘মা-বাবার অবস্থা ছোট থেকেই দেখে আসছি। আমি জানি, খুব ইচ্ছে থাকলেও আমাকে পড়ানোর উপায় ওঁদের নেই। তবু ওঁরা পাশে না থাকলে এই ফল করতে পারতাম না। ধন্যবাদ জানাতে চাই শিক্ষকদেরও। এখন দিনে চার-পাঁচ ঘণ্টা কাজ করি। তাতে মাসের শেষে হাতে হাজার দুয়েক টাকা পাই। ও টাকাটা বাবা নেয় না। গৃহশিক্ষক রেখে দিয়েছেন।’’

কিন্তু স্কুল শুরু হয়ে গেলে কাজ করবে কী ভাবে?

চুপ করেছিল সুমন্ত। তার পর মাথা তুলে বলল, ‘‘ঠিক পারবো। পারতে আমাকে হবেই।’’

বিস্ময়ের ঘোর কাটছিল না। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়েই ছিলেন মা। অস্ফূটে বললেন, ‘‘কত বড় হয়ে গেল না ছেলেটা। আমরা তো বেশি পড়তে পারেনি। অভাবের সংসারে ও যেন এ যুদ্ধ জিততে পারে।’’

যোগাযোগ: ৯৭৩২৯১৮৩৬৮

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

madhyamik student
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE