সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালগুলির ভার আর একা টানা যাবে না, বুঝেই আংশিক ভাবে তা বেসরকারি হাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল রাজ্য সরকার। স্থির হয়েছে, দৈনিক পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে বেসরকারি হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা জেলার সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে আউটডোর করবেন। আপাতত রাজ্যের বিভিন্ন জেলার মোট ১০টি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালকে বেছে নেওয়া হয়েছে। সেখানে ডাক্তার পাঠাবে কলকাতার অ্যাপোলো গ্লেনেগেলস হাসপাতাল।
অ্যাপোলোর সিইও রূপালি বসু জানান, জঙ্গলমহলের তিনটি, বাঁকুড়ার একটি, বীরভূমের তিনটি এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার তিনটি হাসপাতালে মোট ১২টি ক্ষেত্রে পরিষেবা দেবেন অ্যাপোলোর ডাক্তাররা। এ জন্য ৪০ জন ডাক্তারকে বাছাই করা হয়েছে। এক একটি রোগের ক্লিনিক সপ্তাহে এক দিনই হবে। এক একটি হাসপাতালে সপ্তাহে তিনটি থেকে ছ’টি পর্যন্ত ক্লিনিক বসবে।
কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ইতিমধ্যেই কতগুলি প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। প্রথমত, কলকাতা থেকে অতটা দূরত্বে নিয়মিত যাবেন তো এই ডাক্তাররা? কত ক্ষণ থাকবেন তাঁরা? এক এক দিন হাসপাতালগুলিতে প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ রোগী আউটডোরে আসেন। চিকিৎসকেরা কি প্রত্যেক রোগীর ক্ষেত্রে সুবিচার করতে পারবেন? সরকারি হাসপাতালের আউটডোরে সিনিয়র ডাক্তাররা সব রোগী দেখেন না। প্রাথমিক ভাবে দেখেন জুনিয়ররাই। এ ক্ষেত্রে কী হবে?
শুধু রোগী দেখা তো নয়। যদি রোগীকে ভর্তি করার প্রয়োজন হয়, সে ক্ষেত্রে কী হবে? রূপালিদেবী বলেন, ‘‘অবশ্যই সরকারি হাসপাতালে রেফার করা হবে। আমাদের নিজেদের হাসপাতালে রেফার করার প্রশ্নই নেই।’’ কিন্তু যে সব আধুনিক পরীক্ষানিরীক্ষার ব্যবস্থা ওই হাসপাতালে নেই, কিংবা এমন কোনও অস্ত্রোপচার, যার পরিকাঠামো কলকাতার মেডিক্যাল কলেজগুলিতেও গড়ে ওঠেনি, সে ক্ষেত্রে কী হবে? এর কোনও স্পষ্ট জবাব পাওয়া যায়নি।
এই ব্যবস্থায় সরকারের উদ্দেশ্য কত দূর সফল হবে, সে নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। চিকিৎসকদের একটা বড় অংশই বলছেন, গ্রামে আধুনিক চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য সরকারের এই উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু টাকার বিনিময়ে ডাক্তার পাঠানো ছাড়া বেসরকারি হাসপাতালের আর কী স্বার্থ থাকছে? এমন কথাও উঠছে যে এটা কি কালক্রমে ঘুরিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে রোগী নিয়ে আসার সমান্তরাল পথ আরও প্রশস্ত করবে?
স্বাস্থ্য দফতরের একটা অংশ তো বটেই, বহু বেসরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররাও কিন্তু মনে করছেন, এই নয়া ব্যবস্থায় সরকারি থেকে নির্দিষ্ট বেসরকারি হাসপাতালে রোগী রেফারের সংখ্যা বাড়বে। বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কুণাল সরকার বলছেন, ‘‘বেসরকারি হাসপাতালের ক্ষেত্রে প্রলোভন জয় করাটা খুব কঠিন কাজ।’’ আর একটি বেসরকারি হাসপাতালের সিইও রূপক বড়ুয়া রাখঢাক না করেই বলেন, ‘‘রোগী নিজেদের হাসপাতালে রেফার করাটা তো স্বাভাবিক। বাণিজ্যিক স্বার্থ ছাড়া খামোখা একটা হাসপাতাল এত জন বিশেষজ্ঞকে এত দূরে ছাড়বে কেন?’’
রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা অবশ্য আশ্বাস দিয়েছেন, ‘‘বেসরকারি হাসপাতালে রোগী রেফার করাটা আমরা কোনও ভাবেই হতে দেব না। তবে কী ভাবে সেই না হওয়াটা নিশ্চিত করা যাবে, তা নিয়ে এখনও কোনও স্পষ্ট নীতি তৈরি হয়নি। এক বার কাজটা শুরু হলে হয়তো অনেক কিছু স্পষ্ট হবে।’’
সরকারের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে চিকিৎসকদের একটা মহলে। সিপিএম প্রভাবিত চিকিৎসক সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টরস’–এর তরফে গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘প্রথমে আউটডোর দেওয়া হয়েছে, এর পরে ইন্ডোরও দেওয়া হবে। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সাধারণ মানুষ।’’ তৃণমূল চিকিৎসক সংগঠনের তরফে শান্তনু সেনের পাল্টা বক্তব্য, ‘‘এটা সাময়িক বন্দোবস্ত। গত কয়েক বছরে নতুন কলেজ হয়েছে, আসনও বেড়েছে। এ বার সমস্যাটা কমবে।’’
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে ক্যালিব্রেশন অর্থাৎ চিকিৎসা সরঞ্জামের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও বেসরকারি সংস্থার সহায়তা নিতে চলেছে রাজ্য সরকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy