প্রতি বছর পুজোয় ভিন্রাজ্যে ঢাক বাজাতে যান তাঁরা। কিন্তু কখনও কোনও সমস্যা বা আশঙ্কার কথা মাথায় আসেনি। এ বারও বায়না মিলেছে। কিন্তু বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাভাষীদের উপর ‘হেনস্থা’য় এ বার আতান্তরে পড়েছেন বাংলার ঢাকিরা। পুজোয় বাইরে ঢাক বাজাতে গিয়ে কোথাও যাতে কোনও সমস্যায় পড়়তে না-হয়, তার জন্য অনেকেই পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছেন। তা নজরে রেখে রাজ্য জুড়ে ঢাকিদের জন্য পরিচয়পত্র এবং ‘পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট’-এর ব্যবস্থা করছে প্রশাসন।
মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন থানা এলাকার প্রায় ৩০০ জনের বেশি ঢাকি পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করেছেন। পুলিশ সূত্রে খবর, ইতিমধ্যেই তাঁদের অনেকে তা পেয়েও গিয়েছেন। মহালয়ার আগে এই সংখ্যাটা কয়েক হাজার হবে বলে অনুমান পুলিশের। মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার এসডিপিও উত্তম গড়াই বলেন, ‘‘ঢাক বাজাতে যাওয়ার আগে অনেকেই পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করেছেন। নিয়ম মেনে সেই শংসাপত্র দেওয়া শুরু হয়েছে।’’
প্রশাসনিক সূত্রে খবর, মুর্শিদাবাদে ১২ হাজারের কাছাকাছি ঢাকি রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অন্তত ৭০০-৮০০ জন দুর্গাপুজো এবং কালীপুজোয় ভিন্রাজ্যে ঢাক বাজাতে যান। জেলা শ্রম দফতর সূত্রে খবর, মালদহেও দু’হাজারের বেশি ঢাকি রয়েছেন। শুধুমাত্র ইংরেজবাজার ব্লকেই অন্তত ৫০০ জনের বাস। তাঁদের অধিকাংশই পুজোর মরসুমে উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, দিল্লি, বিহার ও অসমে যান ঢাক বাজাতে।
বাঁকুড়ার মহিলা ঢাকি দলের চাহিদাও উত্তরোত্তর বাড়ছে ভিন্রাজ্যে। পাত্রসায়র ব্লকের বেশ কয়েকটি ঢাকি দল ইতিমধ্যেই মুম্বই, উত্তরপ্রদেশ ও দিল্লির বড় পুজোগুলো থেকে বায়না পেয়েছে। সব মিলিয়ে জেলার প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ জন ঢাকি পাড়ি দেবেন বাইরের রাজ্যে। পূর্ব বর্ধমানের ঢাকিরাও ভিন্রাজ্যে যান।
মালদহের পুলিশ সুপার প্রদীপকুমার যাদব বলেন, ‘‘বেশ কিছু আবেদন জমা পড়েছে। প্রত্যেকটি আবেদন যাচাই করে যত দ্রুত সম্ভব সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছে। ঢাক বাজাতে গিয়ে জেলার ঢাকিদের যাতে হেনস্থার মুখে পড়তে না হয়, সেই জন্যই এই ব্যবস্থা।’’
বাঁকুড়ায় আবেদন জমা পড়া শুরু হলেও, এখনও সার্টিফিকেট দেওয়া শুরু হয়নি। জেলার ডিএসপি (ডিআইবি) রাজীবরঞ্জন সিংহ বলেন, ‘‘পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন জমা পড়ছে। তার মধ্যে কত জন ঢাকি, সেটা এখনই আলাদা করে চিহ্নিত করা মুশকিল।’’
পুলিশের তরফে বিশেষ শংসাপত্রের ব্যবস্থা করা হলেও অনেকের আশঙ্কা কাটছে না। বেলডাঙার বাঁশচাতর গ্রামের ঢাকি বিশ্বনাথ দাস, ‘‘এ বছর আমাদের গ্রাম থেকে দুটো দল মুম্বই এবং একটি দল দিল্লিতে ঢাক বাজাতে যাচ্ছে। পুলিশের থেকে ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট নিয়েই আমরা যাচ্ছি। কিন্তু তার পরেও আশঙ্কা পুরোপুরি কাটছে না। আবার যেতেও হবে। নইলে সংসার চলবে না।’’
অন্য দিকে, মালদহের গাজলের ঢাকি শ্রীধর রুইদাস বলেন, ‘‘পুলিশ যে সার্টিফিকেট দিচ্ছে, তাতে ভয় কিছুটা হলেও কেটেছে। এখন খানিক আশ্বস্ত।’’
পুলিশ প্রশাসনের পাশাপাশি ‘পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্যমঞ্চ’ নামে একটি সংগঠনও ভিন্রাজ্যে যেতে চাওয়া বাংলাভাষী ঢাকিদের জন্য নাম, ঠিকানা, রক্তের গ্রুপ, মোবাইল নম্বর এবং সংশ্লিষ্ট থানার তথ্য উল্লেখ করে একটি পরিচয়পত্র দিচ্ছে। আধার কার্ড, ভোটার কার্ড থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশি সন্দেহে বাংলাভাষীদের উপর হেনস্থা হচ্ছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে, তা নজরে রেখেই এই উদ্যোগ বলে জানিয়েছে ওই সংগঠন। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আসিফ ফারুক বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ থেকে ভিন্রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া বাংলাভাষী মানুষদের যাতে হেনস্থার শিকার হতে না হয়, সে জন্য সংগঠনের পক্ষ থেকে তাঁদের একটি পরিচয়পত্র দেওয়া হচ্ছে। আবেদনকারীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সমস্ত খোঁজখবর করে এই কার্ড তৈরি করা হচ্ছে।’’