চলতি বছরের সংশোধিত হিসাবে ৩ শতাংশের বেশি কমেছে রাজ্যের নিজস্ব জিএসটি (এসজিএসটি অথবা পণ্য পরিষেবা কর) আদায়। তবু আগামী (২০২৫-২৬) আর্থিক বছরের বাজেট বরাদ্দে এসজিএসটি থেকেই বিপুল আয়ের আশা রাখছে রাজ্য। ঘটনাচক্রে, গত ১ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেটে বড় অঙ্কের কর ছাড়ের ঘোষণা করেছিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। সেই বাজেটে রাজ্যের কোনও উপকার হবে না— এই অভিযোগ তুলেছিল রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল। যদিও অর্থনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের অনুমান, কর ছাড়ের ঘোষণায় বৃহৎ সংখ্যক মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবী উপকৃত হবেন। ফলে মধ্যবিত্তের হাতে খরচ যোগ্য বাড়তি টাকা বাড়বে এবং ভোগ্যপণ্য ও পরিষেবা ক্ষেত্রে খরচ বাড়তে পারে বলে আশা কেন্দ্রের। একই আশায় এসজিএসটি আদায়ের বড় লক্ষ্য রাখা হয়েছে বুধবার পেশ হওয়া রাজ্য বাজেটেও।
২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের বাজেটে প্রায় ৪৭ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা এসজিএসটি আদায়ের আশা করেছিল রাজ্য। কিন্তু সেই বছরের সংশোধিত হিসাব বলছে, সেই লক্ষ্যমাত্রার থেকে ৩.০৯% কমেছে এসজিএসটি বাবদ আয়। সংখ্যার নিরিখে লক্ষ্যমাত্রার থেকে ১৪৬৪ কোটি টাকা কমে তা হয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। তা সত্ত্বেও ২০২৫-২৬ আর্থিক বছরের বাজেটে এসজিএসটি থেকেই প্রায় ৪৯ হাজার ৭৭১ কোটি টাকা আদায় হতে পারে বলে আশা করেছে রাজ্য। শতাংশের হিসাবে তা ৮.৫%। অর্থনীতিবিদদের একাংশ জানাচ্ছেন, সাধারণ মানুষের হাতে বাড়তি টাকা এলে তাদের কেনাকাটার চাহিদা বাড়ে। আয়কর ছাড়ের ফলে বড় সংখ্যক চাকুরিজীবীর হাতে বাড়তি টাকা থাকবে ধরে নেওয়া যায়। তার কিছুটা সঞ্চয় হলেও, বাকিটায় কেনাকাটা বাড়বে বলে ধরে নেওয়া যায়। পাশাপাশি, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক রেপো-রেট কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বড় অঙ্কের কেনাকাটায় ঋণ নেওয়ার প্রবণতাও বাড়তে পারে। বাড়তে পারে বাড়ি-গাড়ি কেনার প্রবণতাও। সব মিলিয়ে তা বাজার অর্থনীতির উপর ইতিবাচক প্রভাব রাখবে। যার সুফল আসতে পারে এসজিএসটি আদায়েও।
অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় বাজেটে আয়কর ছাড়ের ফলে সাধারণের হাতে টাকা আসবে ধরা হচ্ছে। তা হলে কেনাকাটাও বাড়বে। আবার রেপো-রেট কমায় ঋণ করেও বড় কিছু কিনে প্রয়োজন মেটাতে চাইবেন মানুষ।’’ প্রশাসনের এক শীর্ষকর্তার কথায়, ‘‘প্রয়োজন মেটাতে মানুষ এমন কিছু জিনিস কেনেন, যার উপর জিএসটি-র হার কম। আবার জিএসটি বেশি, তেমন ভোগ্যপণ্যের কেনাকাটাও বাড়ে। রেস্তরাঁয় খাওয়া-দাওয়া, সিনেমা বা কোনও বিনোদনে মানুষ যুক্ত হলেও জিএসটি আদায় বাড়বে। ফলে কেন্দ্রের আয়কর ছাড়ের ঘোষণা এবং রাজ্যের এসজিএসটি বৃদ্ধির আশা সম্পর্কযুক্ত।’’ অন্য এক কর্তা অবশ্য বলেন, ‘‘বাজেটে ধরা অঙ্ক সাধারণত একটি লক্ষ্য স্থির করে দেওয়ার মতো। বাস্তবে কী হচ্ছে, তা ধরা পড়ে সংশোধিত হিসাবে। তাই আশাবাদী হওয়া ভাল। কিন্তু কর আদায়ের হ্রাস-বৃদ্ধির বিষয়টি এর উপরে পুরোপুরি নির্ভরশীল, এমনটা ধরে নেওয়া উচিত হবে না।’’
কিন্তু ২০২৪-২৫ বছরে এসজিএসটি আদায় অনুমানের থেকে এক ধাক্কায় ৩%-এর বেশি কমল কেন, তা নিয়ে চর্চা রয়েছে বিভিন্ন মহলে। বিরোধীদের অনেকেরই বক্তব্য, ধারাবাহিক ভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের দাবি করে আসছে রাজ্য। দুর্গাপুজোয় বিপুল আর্থিক কর্মকাণ্ডের তথ্যও তুলে ধরা হয়। আবার বিভিন্ন আর্থিক অনুদান প্রকল্পের কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে বলেও নবান্ন দাবি করে বার বার। তার পরেও এই কর আদায় কমে যাওয়া সেই দাবিগুলির সঙ্গে মানানসই নয়।
যদিও প্রশাসনের একটি অংশের যুক্তি, দীর্ঘদিন ধরেই করছাড়ের মতো আর্থিক কোনও বড় সুবিধা কেন্দ্রের থেকে পাননি মানুষ। তার উপর দ্রব্যপণ্যের চড়া দাম। এক কর্তার কথায়, ‘‘মনে রাখতে হবে, ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে এসজিএসটি যা আদায় হয়েছিল, তার থেকে অনেক বেশি এসেছে ২০২৪-২৫ সালে। ফলে রাজ্যের রাজ্যের আর্থিক নীতি যে সঠিক খাতেই ছিল, তা ধরে নেওয়া যায়।’’ অভিরূপের বক্তব্য, ‘‘এই সময়টায় গোটা দেশেই আর্থিক
বৃদ্ধির হার ভাল ছিল না। তাই কেনাকাটাও বাড়েনি। যার প্রভাব রয়েছে এর উপর।’’
রাজ্যের বাজেট তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ সালের বাজেটে সব মিলিয়ে রাজ্যের নিজস্ব আয়ের আশা করা হয়েছিল প্রায় ১.০২ লক্ষ কোটি টাকা। কিন্তু ওই বছরের সংশোধিত বাজেটে তা ৯৯ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা হয়েছে। অর্থাৎ, এখনও পর্যন্ত নিজস্ব কর আদায় অনুমানের থেকে কমেছে প্রায় ২.৪২%। আদায় হওয়া সেই করের প্রায় অর্ধেক এসেছে এসজিএসটি থেকে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)