পল ফ্রস্ট
মার্কিন শিল্প মানচিত্রে কলকাতার নাম না-ওঠায় বিন্দুমাত্র বিস্মিত নয় শিল্পমহল। তাদের মতে, রাজ্যে শিল্পের যা বাতাবরণ, তাতেঅন্য রকম কিছু হলেই আশ্চর্যের হতো।
সিঙ্গুর কাণ্ডের জেরে ২০০৮ সালে উচ্চ পর্যায়ের মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি দলের সফরসূচি থেকে বাদ পড়েছিল কলকাতা। রাজনৈতিক পালাবদলের পরে তার শিল্প-ভাগ্য তো খোলেইনি, আরও অতলে তলিয়েছে। ফলে সাত বছর পরে মার্কিন সরকারের ‘রোড শো’-এর তালিকায় কলকাতায় ব্রাত্যই।
দিল্লিতে মার্কিন দূতাবাসের কমার্শিয়াল অফিসার পল ফ্রস্ট সোমবার কলকাতা এসে জানিয়েছেন, ভারত থেকে লগ্নি টানতে আগামী অক্টোবরে দিল্লি, মুম্বই ও চেন্নাই শহরে ‘রোড শো’ করবেন তাঁরা। বাণিজ্যিক সাফল্যের সম্ভাবনা নেই, এই যুক্তিতে বাদ গিয়েছে কলকাতা। ফ্রস্টের বক্তব্য, ‘‘ব্যবসায়িক সম্ভাবনার ভিত্তিতেই এই তালিকা তৈরি হয়েছে। ওই তিন শহর থেকে বিপুল সাড়া পাওয়া গিয়েছে। এখানে ততটা সম্ভাবনা দেখা যায়নি।’’ এবং তাঁর যুক্তিতে ফাঁক দেখছে না শিল্পমহল। এক শিল্পকর্তার কথায়, ‘‘ব্যবসা করার আগে সাফল্যের হিসেব কষে নেওয়াটাই তো নিয়ম। পশ্চিমবঙ্গ থেকে ব্যবসা হওয়ার সম্ভাবনা দেখতে না পেলে তাঁরা এখানে আসবেন কেন?’’
শুধু এই ‘রোড-শো’ নয়। ভারত ও মার্কিন মুলুকের বাণিজ্যিক যোগসূত্র তৈরির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ ইউএস-ইন্ডিয়া বিজনেস কাউন্সিলের (ইউএসআইবিসি) কোনও কর্মসূচিতে ২০১৫ সালের অগস্ট মাস পর্যন্ত ঠাঁই নেই কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের। জুলাই ও অগস্ট মাসে দিল্লি, আমদাবাদ, গাঁধীনগর-সহ বিভিন্ন শহরে বৈঠক করবে ইউএসআইবিসি। বাদ কলকাতা। চলতি বছরে দফায় দফায় মার্কিন প্রতিনিধি দল এসেছে বেঙ্গালুরুতে। কখনও তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে পারস্পরিক বিনিয়োগের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে। কখনও ‘ভেঞ্চার ক্যাপিটাল’ বা উদ্যোগ পুঁজি ঢালার সুযোগ খুঁজতে। কলকাতায় তাদের পা পড়েনি।
গাড়ি, ইঞ্জিনিয়ারিং-সহ বিভিন্ন উৎপাদন শিল্পে মার্কিন লগ্নি টানতে রবিবার নিউ ইয়র্কে মার্কিন বাণিজ্য মহলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডনবীস। সোমবার ওয়াশিংটনে মার্কিন শিল্প মহলের সঙ্গে পর্যটন, তথ্যপ্রযুক্তি, পেট্রোপণ্য ও খনিজ শিল্পে বিনিয়োগ করার সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আলোচনা করেছে ওড়িশার প্রতিনিধিদল। পশ্চিমবঙ্গ কোথাও নেই।
আমেরিকার চোখে রাজ্যের এ ভাবে ব্রাত্য হয়ে থাকার কারণ কী? এ প্রসঙ্গে রাজ্য সরকারের বক্তব্য অবশ্য জানা যায়নি। শিল্প এবং অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র ফোন ধরেননি। জবাব দেননি এসএমএসেরও। তবে শিল্পমহলের মতে, লগ্নির গন্তব্য হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে এ রাজ্যের ব্যর্থতাই এর জন্য দায়ী। শিল্পকর্তাদের অনেকেই বলছেন, ২০০৬ সালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তৃতীয় দফায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে রাজ্যে শিল্পায়নের পক্ষে ইতিবাচক বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল। সেই আবহেই ২০০৭ সালের মার্চে প্রেসিডেন্ট রন সমার্সের নেতৃত্বে কলকাতায় এসেছিল ইউএসআইবিসি-র প্রতিনিধি দল। রাজ্যে বিনিয়োগের পরিবেশ ভাল, সে যাত্রা বলেছিলেন সমার্স।
ওই বছরই একই সপ্তাহে শহরে পা রেখেছিলেন মার্কিন অর্থসচিব হেনরি পলসন ও প্রাক্তন মার্কিন বিদেশসচিব হেনরি কিসিংগার। পলসনই প্রথম মার্কিন অর্থসচিব, যিনি কলকাতায় আসেন। বুদ্ধবাবুর সঙ্গে তাঁর বৈঠক হওয়ার কথা ছিল ২৫ মিনিট। কিন্তু আলোচনা গড়িয়েছিল ৪৫ মিনিট। বৈঠকের পরে ‘মুগ্ধ’ পলসন বুদ্ধবাবুকে ‘আর্থিক সংস্কারক’ আখ্যা দিয়েছিলেন। আর কট্টর কমিউনিস্ট-বিরোধী কিসিংগার জানিয়েছিলেন, ‘লগ্নি টানতে বদ্ধপরিকর বাম রাজ্যকে দেখা এবং শিক্ষা নেওয়া’ই তাঁর সফরের উদ্দেশ্য। দু’টি সফরই হয়েছিল এমন সময়ে, যখন আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তি নিয়ে বামেদের বিবাদ তুঙ্গে। কিন্তু পলসন ও কিসিংগার দু’জনেই ওই প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের উপরেই জোর দিয়েছিলেন।
এর পরে কলকাতায় আসেন মার্কিন বাণিজ্য দফতরের সহসচিব ডেভিড বোহিগান। রাজ্যে বিনিয়োগ সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে তাঁর সঙ্গে আমেরিকার প্রথম সারির ১০টি সংস্থার কর্তারাও এসেছিলেন। কলকাতার সঙ্গে প্রতিযোগী হিসেবে উঠে এসেছিল পুণে ও হায়দরাবাদের নাম। কিন্তু বিনিয়োগের সম্ভাব্য গন্তব্য হিসেবে মার্কিন সরকার ও শিল্পমহল সে সময় বেছে নিয়েছিল কলকাতাকেই।
কিন্তু গোটা ছবিটাই পাল্টে দেয় সিঙ্গুরে তৃণমূলের জঙ্গি আন্দোলন। ২০০৮ সালের ২২ সেপ্টেম্বর বোয়িং, ওয়ালমার্ট ও কারগিলের প্রতিনিধিদের নিয়ে ফের কলকাতা আসার কথা কথা ছিল সমার্সের। সে যাত্রা কলকাতা ঘুরে তার পর দিল্লি ও হায়দরাবাদ যাওয়া হবে বলে ঠিক করেছিল ইউএসআইবিসি-র প্রতিনিধি দল। কিন্তু সিঙ্গুর কাণ্ডের জেরে সেই সফর বাতিল হয়ে যায়। কাউন্সিলের সদস্যদের পাঠানো ই-মেলে বলা হয়েছিল জমি নিয়ে যে গোলমাল চলেছে, তাতে বাণিজ্যিক প্রতিনিধি দলের সফর কোনও কাজে আসবে না। আর সমার্স বলেছিলেন, ‘‘রতন টাটা যদি এখানে সাফল্য না-পান, তা হলে মার্কিন বিনিয়োগকারীরা কী করে সফল হবেন?’’
পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে সেই ধারণার আর বদল হয়নি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy