Advertisement
২৮ মার্চ ২০২৩
Rabindra Jayanti

রবীন্দ্রসঙ্গীতও কি এখন বাজারে না ‘খাওয়ালে’ কেউ শুনবে না?

পাশের বাড়ির মিতা বৌদি, পাড়ার শেফালিদি, সবাই নিজের মতো গুছিয়ে নিচ্ছে রবীন্দ্রনাথকে। চারটে সেলিব্রিটির সঙ্গে জনা কুড়ি দাদা-দিদিমণি গীতবিতান হাতে পিশাচ, থুরি পঁচিশ প্রাতে রবি সাথে।

রবীন্দ্রনাথের গান এ বার একটু বাজারে খাওয়াতে হবে। নতুন প্রজন্ম শুনবে না তো!

রবীন্দ্রনাথের গান এ বার একটু বাজারে খাওয়াতে হবে। নতুন প্রজন্ম শুনবে না তো!

স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৮ ২০:১২
Share: Save:

২০১৮-এর হোয়াটস্অ্যাপে রবিঠাকুর জিনস আর টি শার্ট পরা। সঙ্গে দাড়ি! ঘুরছে ভার্চুয়ালে। হিয়ার মাঝে। আজ আমরা ধর্মে বা জিরাফে নয়, শুধু হোয়াটস্অ্যাপে থাকি। সেই আমাদের একটিমাত্র সুখ। তার মধ্যে সাদা-কালো আঁধারে, নতুন কিছু হহুঙ্কারে, উন্মাদনায় রবীন্দ্রনাথের গানের ভিডিয়ো ঘোরাতে থাকি। একরাশ পিঁপড়ের মতো প্যান্ডেলে, পাড়ায়, মাচায় গরমে পচে যাওয়া রজনীগন্ধার মালা, ধূপ নিয়ে গান গেয়ে চলি। কী গান? জানি না! জানি শুধু কতগুলো জায়গায় কত ক্ষেপের গান! আরে এটা ২০১৮, লোক তো সেই কবেকার! রবীন্দ্রনাথের গান এ বার একটু বাজারে খাওয়াতে হবে। নতুন প্রজন্ম শুনবে না তো!

Advertisement

পাশের বাড়ির মিতা বৌদি, পাড়ার শেফালিদি, সবাই নিজের মতো গুছিয়ে নিচ্ছে রবীন্দ্রনাথকে। চারটে সেলিব্রিটির সঙ্গে জনা কুড়ি দাদা-দিদিমণি গীতবিতান হাতে পিশাচ, থুরি পঁচিশ প্রাতে রবি সাথে।

শ্রীকান্ত আচার্যকে ফোনে ধরি। ঠান্ডা মাথায় এক এক করে বিষয়ের গভীরতায় ঢুকে যান তিনি। ‘‘বাঙালি পুরনো অভ্যেস ছাড়ে না। রেডিয়োতে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা আগের বাঙালি প্রজন্ম কেমন যেন মিউ মিউ করে রবীন্দ্রনাথের গান শুনতে চায়। বলে মিউজিকটা বড্ড বেশি, থামাও। কই আমার ছেলেরা, যারা পাশ্চাত্য সঙ্গীত শুনছে, হিন্দি গান শুনছে, তাদের কাছে তো মিউজিকটা লাউড মনে হচ্ছে না!

শ্রীকান্ত আচার্য

Advertisement

আসলে এটা এ সময়ের সাউন্ডস্কেপের গল্প যেখানে সুর আর কথা অক্ষত রেখে বুঝে, জেনে রবীন্দ্রনাথের গানকে নতুন সাউন্ডস্কেপে ঢোকাতে হবে।’’ কথা বলতে গিয়ে কবিপক্ষে প্রকাশিত জয়তী চক্রবর্তীর আকাশ ভরা গানের উদাহরণ দিয়ে বললেন, ‘‘এই গান আজকের সাউন্ডস্কেপের গান।’’ রবীন্দ্রনাথের গান ‘বাজারে খাওয়ানো’র বিষয় নয়, বিষয়টা নতুন শব্দধারায় তাকে উপস্থাপন করার শ্রীকান্ত আচার্যের এই রাস্তা থেকে সরে এলেন মনোময় ভট্টাচার্য। বললেন, ‘‘আমি তিনটে কথা বলব। আজ রবীন্দ্রনাথের গান সকলের বাপের সম্পত্তি হয়ে গেছে। যার কোনও গতি নেই তার রবীন্দ্রগতি! আর এটি প্লিজ লিখুন, কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথের গানকে অন্য রকম করার পাগলামিতে এত হারমোনির প্রয়োজন নেই! সেটার দরকার হলে রবীন্দ্রনাথ নিজেই করে যেতেন! যে পাচ্ছে হারমোনি করছে। সব বদলে দাও! আরে আমি কি আমার বাবার নাম বদলাই? তো রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে এত অদলবদল কেন? নিজের গানে করি না এ সব!’’

রেগে আছেন মনোময়।

মনোময় ভট্টাচার্য

মনোময়ের প্রশ্নের উত্তর কিছুটা জয়তী চক্রবর্তী দিয়ে দেন তাঁর মতো করে। ‘‘আমি আজও দেবব্রত বিশ্বাসের ‘আকাশ ভরা’ শুনি, ওই যখন উনি ‘চমক’ শব্দটা বলেন শিউরে উঠি। আমি কিন্তু কখনওই নিজেকে জাহির করার জন্য হারমোনি করে আকাশ ভরা গাইনি। আমি গানটাকে আজকের প্রেক্ষিতে কেমন দেখছি সেটাই শ্রোতাদের কাছে বলতে চেয়েছি। কারও পছন্দ হবে। কারও হয়তো না-ও হতে পারে! তবে রবীন্দ্রনাথের গান যেখানে থাকার সেখানেই আছে। তাকে বাজারে খাপ খাওয়ানোর স্পর্ধা আমাদের কারও নেই!’’

জয়তী চক্রবর্তী

তা হলে রবিবাবুর গানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে।

শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে থাকা শ্রাবণী সেন বলছেন, তাঁর পাঁচশো ছাত্রছাত্রী। এ প্রজন্মের তারা সকলেই। ‘‘কেউ তো বলছে না কিছু বদল ঘটিয়ে রবীন্দ্রনাথের গানকে বাজারের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হবে! তবে অনেক দিন আগে ‘আমার পরান যাহা চায়’ গানের সঙ্গে জয় সরকার স্যাক্সোফোন বাজিয়েছিল। অসাধারণ কাজ ছিল সেটা,’’ আবেগ শ্রাবণীর গলায়।

শ্রাবণী সেন

প্রশ্নটা শুনেই হেসে বললেন ইমন চক্রবর্তী। ‘‘রবীন্দ্রনাথের গান আর বাজারে কি খাওয়াতে হবে? রবীন্দ্রনাথই তো আমাদের খাওয়াচ্ছেন। আসলে বিষয়টা পরিবেশন শৈলীর ওপর নির্ভর করে। আজ এস্রাজ, তবলার মোহরদি, সুচিত্রাদি, ঋতুদির গান তো শুনি আমরা। কিন্তু তার সঙ্গে এটাও ঠিক সময় বদলাচ্ছে। কথা বলা আমাদের পোশাক বদলাচ্ছে। তেমনই কেউ শুধু গিটার নিয়ে কথার মানে বুঝে যদি গান গায় তা হলে ক্ষতি কী?’’

ইমন চক্রবর্তী

সময়টা অমধুর মনে করেন লোপামুদ্রা মিত্র। তাই হয়তো রবীন্দ্রনাথকে বদলাতে গিয়ে সকলের সব কাজ ভীষণ মধুর হয়ে উঠছে না। তবে তিনি মনে করালেন ২০০২-তে জয় সরকারের সঙ্গে তিনি এক্সপেরিমেন্ট করার কথা ভেবেছিলেন।’’ তবে আজ মনে হয় সিদেসাধা অ্যারেঞ্জমেন্টে গাই।’’

গানের জগতের বাইরে নাট্যকার, সুররসিক ব্রাত্য বসুকে এ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘সার্বিক সাংস্কৃতিক অবক্ষয়। এ তারই অঙ্গ।’’ অন্য দিকে জয় গোস্বামীও স্তব্ধ। ‘‘সত্যি আমি জানি না কী বলব! এ অবস্থা দেখে অসহায় হয়ে থাকি।’’

লোপামুদ্রা মিত্র

এই লেখার মাঝেই হোয়াটস্অ্যাপ আর মেসেঞ্জারে ভেসে উঠছে ‘পঁচিশে বৈশাখের অগ্রিম শুভেচ্ছা।’ আমার জন্মদিন তো নয়। বিজয়া দশমী বা পয়লা বৈশাখ, নিদেনপক্ষে হ্যাপি নিউ ইয়ার ও...নাহ্! শুভেচ্ছা পেতে পেতে শুভেচ্ছা কেমন কেচ্ছার মতো ঠেকছে! হায় হায় গান হায় ভেসে যায় কোন কোলাহলে!

ব্রাত্য বসু

সাহানা বাজপেয়ী অবশ্য শ্রোতাদের গুরুত্ব দিলেন। তাঁর মতে, ‘‘রবীন্দ্রসঙ্গীতের শ্রোতারা যথেষ্ট বোঝদার। তাঁদের যেমন তেমন করে গান খাওয়ালেই তাঁরা খাবেন না। গান খাওয়ানোর চেয়ে গানের রেশ রয়ে যাওয়াটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’’

চলচ্চিত্র পরিচালক অতনু ঘোষ আবার মনে করেন, ‘‘রবীন্দ্রসঙ্গীত শুধুই ভালবেসে গাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই ব্যাকরণ, শৈলী, স্বরলিপি ইত্যাদি নিয়ে ভাবতেই হবে। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন যে তাঁর গান বিকৃত করা চলে না।

জয় গোস্বামী

হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গে নিজের গানের তফাৎ বোঝাতে গিয়ে বলেছেন যে হিন্দুস্তানী সঙ্গীতের সুরের মধ্যে যে ফাঁক গায়কের‌ জন্য রাখা থাকে, রবীন্দ্রসঙ্গীতে তা নেই। বরং বলা যায় রবীন্দ্রসঙ্গীত নিজস্ব ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। কাজেই ইওরোপীয় পদ্ধতির মতো স্বরলিপির মধ্যেই গায়কি সীমাবদ্ধ।’’ অতনু বললেন, ‘‘আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, রবীন্দ্রনাথ কথা ও সুরকে সমান অধিকার দিয়েছেন। কাজেই সুর অবিকৃত থাকলেও যদি কথার ভাব, মীড়, দরদ ঠিকমতো প্রকাশ না পায়, তা হলেও গায়ক ব্যর্থ।

সাহানা বাজপেয়ী

কথা ও সুরের পর ছন্দের ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভিন্ন ভিন্ন রূপ আজকাল শোনা‌ যায়। তা ছাড়া প্রায়ই বেশ কিছু গান মুক্তছন্দে বা অ্যাডলিব-এ গাওয়া হয়। বিশেষ করে সিনেমা বা সিরিয়ালে। লয় নিয়েও নানা পরিবর্তন বেশ অনায়াসেই করে নেওয়া হয়।’’ অতনুর ক্ষোভ: ‘‘ক’জন আর ভাবেন, এতে গানের মূল ভাব বিকৃত হচ্ছে কি না। আর অর্কেস্ট্রেশন নিয়ে তো পরীক্ষা-নিরীক্ষার শেষ নেই।

অতনু ঘোষ

এখানে তো স্বরলিপিতেও কোনও নির্দেশ পাওয়া যাবে না। কাজেই অবাধ সুযোগ। আর শিল্পীর উচ্চারণ, গলা কাঁপানো ও ক্যামেরার সামনে নানা অদ্ভুত অভিব্যক্তিও অনেক সময় যথেষ্ট বিরক্তিকর মনে হয়।’’ এরই পাশাপাশি এই পরিচালক অবশ্য বলছেন, ‘‘নতুন প্রজন্মের বেশ কিছু শিল্পীর গান মন ছুঁয়ে যায়। বলা বাহুল্য, তাঁদের যত্ন আছে,‌ সাধনা আছে । সবচেয়ে বড় কথা,‌ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার বিষয়ে তাঁরা সচেতন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.