Advertisement
E-Paper

এক বুক আংড়াভাসা নিয়ে বসে রয়েছি

পুজোর পরে তিস্তার চরে জলে টান পড়ত। দুদ্দাড় করে বালির চর মাথা চাড়া দিত। সেখানে চলত পক্ষীরাজ। জল ফিরলে উধাও হয়ে যেত তারা। লিখছেন সমরেশ মজুমদারপুজোর পরে তিস্তার চরে জলে টান পড়ত। দুদ্দাড় করে বালির চর মাথা চাড়া দিত। সেখানে চলত পক্ষীরাজ। জল ফিরলে উধাও হয়ে যেত তারা। লিখছেন সমরেশ মজুমদার

শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৮ ০২:০৮
জগদ্দল: অযান্ত্রিকের এই গাড়িটির মতোই দেখতে ছিল পক্ষীরাজ।

জগদ্দল: অযান্ত্রিকের এই গাড়িটির মতোই দেখতে ছিল পক্ষীরাজ।

নিজের হাতের রেখাগুলোকে আজও চিনতে পারলাম না। ওদের গতিপ্রকৃতি যে অর্থবহ তা অবশ্য শুনে আসছি অথচ তার সত্যাসত্য বোঝার বাইরে থেকে গিয়েছে। কিন্তু যে শহরে সেই চার বছর বয়সে পিতামহ এবং বড় পিসিমার সঙ্গে এসেছিলাম, সেই জলপাইগুড়ির বড় রাস্তাগুলো তো বটেই, প্রতিটি অলিগলি চিনে ফেলেছিলাম দশ-বারো বছর বয়স হতেই।

তখন জলপাইগুড়ি শহরটা ছিল আমার আয়ত্তের মধ্যে। বারো বছর বয়স হতে না হতে সেনপাড়া থেকে মাসকলাইবাড়ি শ্মশান, পাণ্ডাপাড়া থেকে রাজবাড়ি পর্যন্ত টহল দিতাম সাইকেলে। চার বন্ধুর চার সাইকেল। তখনও তিস্তায় বিস্তর জল, বাঁধ তৈরির তোড়জোড় চললেও শীতের ভোরে বছরের শেষে হাজির হয়ে যাচ্ছে পক্ষীরাজ ট্যাক্সিগুলো।

হাকিমপাড়ায় আমার পিতামহের বাড়ি। তার গায়ের মাঠটার নাম ছিল কোচবিহার মাঠ। জলপাইগুড়ি শহরের বুকে কয়েকবিঘা জমি বুনো ঝোপ নিয়ে পড়ে থাকত, তার নাম কেন কোচবিহার মাঠ হয়েছিল বালকবয়সে তা জানতে কৌতূহলী হইনি। ঠিক তারপরেই তিস্তার ঢেউ যা বর্ষাকালে মাঠের প্রান্তে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলত। ভর বর্ষায় হাকিমপাড়া-সেনপাড়া ছুঁয়ে যাওয়া তিস্তার জলের অন্য প্রান্ত বইতো বার্নিশকে স্পর্শ করে। তখন নদীর উপর সেতু নেই, হচ্ছে-হবে এই আশায় রয়েছে। জলপাইগুড়ির কাছারি ঘাট থেকে যাত্রী বোঝাই নৌকোর গুণ টেনে মাঝিরা নিয়ে যেত প্রায় জেলাস্কুলের কাছাকাছি। নিয়ে গিয়ে তিস্তার স্রোতে নৌকো ভাসিয়ে দেওয়া হত। মাঝনদীতে নৌকো এই ডোবে কী সেই ডোবে! এ ওকে আঁকড়ে ধরে কোন ভগবানকে ডাকবে ভেবে পেত না। দক্ষ মাঝিরা সেই নৌকা পৌঁছে দিত বার্নিশের ঘাটে। বার্নিশে যাত্রী পৌঁছে দিয়ে পরপর দাঁড়িয়ে আছে প্রচুর বাস। তাদের বাসের বাহার অনেক। কেউ যাবে আলিপুরদুয়ার, কেউ কোচবিহার, কেউ বানারহাট অথবা নাথুয়া। নৌকোর যাত্রীরা দৌড়ে যায় নিজের জায়গায় যাওয়ার বাসে আসন পাওয়ার জন্য। ভাতের হোটেল থেকে হাঁক ভেসে আসে, ‘আসুন ভাই বোরোলি মাছ আর গরম ভাত, খাবেন আর জুড়াবেন। আসুন দাদারা।’

পুজো গেল, কালীপুজো রমরমিয়ে চলে যেতে তিস্তার জলে টান পড়ত। তারপর দুদ্দাড় করে বালির চর মাথা চাড়া দিত। শেষপর্যন্ত জলপাইগুড়ির কাছারি ঘাটের কাছে সরু এক চিলতে তিস্তা যার গভীরতা হাঁটু স্পর্শ করে না আর ওদিকে বার্নিশের গা ঘেঁষে খানিকটা চওড়া, জল কমে এলেও কিছুটা গভীর এবং গম্ভীর তিস্তা বয়ে যায় পাকিস্তানের দিকে।

আর দুই ভাগ হওয়া নদীর মাঝখানে প্রায় একমাইল গজিয়ে ওঠা বালির চরে উঁকি মারছে কাশগাছ। সেই কাশগাছের মধ্যে দিয়ে রাস্তা করে নিয়েছে অনেকগুলো পক্ষীরাজ ট্যাক্সি।

অনেক পরে যখন আমি ঋত্বিক ঘটকের ‘অযান্ত্রিক’ ছবিটি দেখেছিলাম তখন অবাক হয়েছিলাম। অযান্ত্রিকের সেই ট্যাক্সির মতো হবহু দেখতে ডজনখানেক ট্যাক্সি পুরো শীতকাল দাপিয়ে বেড়াতো জলপাইগুড়ির তিস্তার চরে। লম্বা, রংচটা, বসার আসনে গদি নেই বললেই চলে, স্প্রিং-এর উপর দু’দুটো বস্তা চাপানো যাতে যাত্রীদের পশ্চাৎদেশ অক্ষত থাকে। আর যত পারা যায় তত যাত্রী তোলা হত সেই পক্ষীরাজ ট্যাক্সির শরীরে। একদিকের লম্বা পাদানিতেও অল্পবয়সী যাত্রী। ইঞ্জিন চালু হলে আর হর্ন বাজাবার দরকার হত না। ইঞ্জিনের আওয়াজে সদ্য বধির ভেবে নিত, সে শ্রবণশক্তি ফিরে পেয়েছে।

ছয় বছর বয়েসে আমি পিতামহের সঙ্গে প্রথমবার পক্ষীরাজ ট্যাক্সিতে উঠেছিলাম। সেই রোমাঞ্চকর স্মৃতি আজও মনে থেকে গিয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশে পিলে চমকানো গাড়িতে উঠেছি কিন্তু সেই পক্ষীরাজের উদ্দামতাকে ম্লান করতে তারা পারেনি। পশ্চাৎদেশে স্প্রিং ফুটছে, পক্ষীরাজ যাত্রীদের শরীর নাচিয়ে চলেছে। পুজো চলে গেলেও কাশফুল থেকে যাওয়া ডালগুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলছে। আবার চলতে-চলতে তীব্র প্রতিবাদ করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। তখন ড্রাইভার বালিতে নেমে একটা কাশগাছের গোড়া থেকে শরীর তুলে নিয়ে এসে যেই ইঞ্জিনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে অমনি ইঞ্জিনের ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। হাসিমুখে ড্রাইভার তাকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বার্নিশের ঘাটের দিকে। এই দৃশ্য এখনও আমার কাছে মায়ায় মাখানো।

কিন্তু বৈশাখে যেই কালবৈশাখী আছড়ে পড়ত তখনই আমরা বুঝতাম জলপাইগুড়ির তিস্তার পক্ষীরাজের এই বছরের আয়ু ফুরিয়ে এল। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তিস্তার শুকনো বালির নীচে বোম ফাটা শুরু হবে। তার আওয়াজ শুনে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় বিছানায় উঠে বসতো সেনপাড়া-হাকিমপাড়ার অনেক মানুষ। ভোর হতে না হতেই ছুটতাম তিস্তার চরে। কাল যা ছিল শুকনো বালি, আজ তা ভিজে কাদা। দুপুরের পর নীচ থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল মাটির উপর উঠে এল। সন্ধ্যের মুখে পায়ের পাতা ভেজে কি না ভেজে! কিন্তু পরের সকালে গিয়ে দেখলাম, কোথায় বালি! তিস্তার বুকে আধহাঁটু জল তির তির করে বইছে। বয়স্করা বলতেন, ‘‘এটা নদীর নীচের জল, এরপর পাহাড় থেকে উপরের জলের ঢল নামলে তাতে মিশে যাবে।’’

তারপর তিস্তায় গায়ে বাঁধ বসল। তৈরি হল ট্রেন এবং গাড়ি চলাচলের লম্বা ব্রিজ। সঙ্গে সঙ্গে পক্ষীরাজ ট্যাক্সিগুলো উধাও। কেউ বলল, বিহার-উত্তরপ্রদেশের নদীর চরে ছোটাছুটি করছে তারা। মন খারাপ হল। বালক বয়সেই আপনজনকে ছাড়ার শিক্ষা শুরু হতে লাগল একের পর এক।

আর আশ্চর্যের ব্যাপার, তিস্তায় জল কমতে শুরু করল হু হু করে। সেবক পার হওয়ার পর থেকেই তো তিস্তাকে বাঁধার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। তবু শেষবার তিস্তা চেষ্টা করেছিল আটষট্টি সালের দুর্গাপুজোর ঠিক পরে। বাঁধন ছিঁড়ে রানি তিস্তা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জলপাইগুড়ি শহরের উপর। চুরমার করে কোমর ভেঙে দিয়েছিল শহরটার। ছাদ ভাসিয়ে যাওয়া জলের স্রোত নিয়ে গেছে কত প্রাণ। বন্যার পরের দুপুরে ময়নাগুড়ি থেকে হাঁটতে হাঁটতে তিস্তা ব্রিজের উপর উঠে দেখেছিলাম, প্রায় কালো জল তখনও শোঁ শোঁ করছে। কিন্তু সেই শেষ। তিস্তা শেকলে বাঁধা পড়ল। জলপাইগুড়ি-বার্নিশের বিশাল তিস্তা গেল শুকিয়ে। সাহসী মানুষেরা সেই নদীর চরে প্রথমে অস্থায়ী, পরে স্থায়ী বাসস্থান তৈরি করে নিল। এক চিলতে জলের ধারা, তাই নিয়েও রাজনীতির তরজা শুরু হয়ে গেল।

এই সেদিন জলপাইগুড়িতে গিয়েছিলাম। টাউনক্লাবের পাশ দিয়ে তিস্তায় বাঁধ। মনে হল বাঁধটা যেন অনেকটা বসে গিয়েছে। আমার বন্ধু যে জলপাইগুড়িতেই থেকে গিয়েছে, বলল, ‘‘এক সময় বাঁধ বলে চেনা যাবে না। নদীটাকে যখন মেরে ফেলা হয়েছে তখন বাঁধের আর কী প্রয়োজন!’’

এইসব স্মৃতিগুলো বুকের ঘরে চুপচাপ থেকে গিয়েছে। মাঝে মাঝে হাওয়া ঢোকে সেই ঘরে, এই যেমন আজ। মনের শিরাগুলো টনটন করে ওঠে।

Samaresh Majumdar Ajantrik সমরেশ মজুমদার
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy