শ্রদ্ধা-স্মরণ: দার্জিলিঙে নিজেদের বাড়িতে পেম্বা শেরপার জন্য প্রার্থনায় রত পরিবারের সকলে। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক
প্র: তিন ছেলেই পর্বতারোহী। কবে থেকে তারা পাহাড়ে অভিযান করছেন?
উ: ফুরকিমা শেরপা (পেম্বা শেরপার মা): ছোটবেলা থেকেই ওরা ট্রেকিং করত। তারপর পাহাড়ে চড়ার প্রশিক্ষণ নিল। প্রথম পেম্বাই এভারেস্টে চড়ে। ২০০০ সালে। তারপর থেকে অনেকবার (১৭ বার) গিয়েছে। কিন্ত এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছতে সফল হয়েছে আটবার। তারপর আমার বড় ছেলে পাসাং শেরপা ২০০৭ সালে এবং ছোট ছেলে তাশি ২০১৩ সালে সর্বোচ্চ শৃঙ্গে ওঠে। তিনভাই একসঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘায় উঠেছিল ২০১১ সালে। সেজ ছেলে মিনমা শেরপা ট্রেকিংয়ের গাইড হিসেবে কাজ করে। সে পর্বতারোহণে সেরকম যায় না।
প্র: ছেলেদের ঝুঁকিপূর্ণ এই কাজে কখনও যেতে বারণ করেছেন?
উ: পেম্বাকে বলেছি, অনেকদিন থেকে এ কাজে রয়েছিস। এবার অন্য কিছু কাজ কর। কিন্ত পেম্বা তিন ছেলেমেয়ের পড়াশোনা চালানোর জন্য অনেক পরিশ্রম করত। পেম্বার আয়ের উপর ওর পরিবার নির্ভরশীল ছিল। তাই ওর পায়ে ব্যথা সত্ত্বেও তাকে যেতে হত। এরই মধ্যে দুর্ঘটনা ঘটে গেল। ছেলের দুর্ঘটনার বিষয়ে আমি আর কিছু বলতে পারব না।
প্র: কতদিন ধরে আছেন দার্জিলিঙে?
উ: আমরা দীর্ঘদিন ধরেই দার্জিলিঙের এই পাঞ্ছিপুল এলাকায় রয়েছি। আমার স্বামী লাকপা দোরজি আগে কৃষিকাজ করতেন। তারপর সংসারে একটু আয় শুরু হল যখন পেম্বা প্রথম এভারেস্টে পর্বতারোহনের পর কিছু টাকা হাতে পেল। তা দিয়ে এখানে ঘর তৈরি করা শুরু হল। তার আগে পাশেই আমার বড় ছেলে পাসাংয়ের পুরনো বাড়িতেই আমরা সবাই থাকতাম। তারপর পেম্বাই সবার জন্য বড় এই বাড়িটি তৈরি করল। পরিবারের সবচেয়ে বড় ভরসা ছিল পেম্বাই। তাকে যে এভাবে হারাতে হবে তা কোনওদিনও ভাবিনি।
প্র: বাড়িতে থাকলে পেম্বা কী করতেন?
উ: ছকপা শেরপা (পেম্বার স্ত্রী): সারা জীবনে স্বামীকে বাড়িতে খুব কমই পেয়েছি। বছরের বেশিরভাগ সময় কোনও না কোনও অভিযানে ব্যস্ত থাকতেন উনি। তবে বাড়িতে থাকলে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সময় কাটাতেন। ওদের পড়াশোনা নিয়েই বেশি চিন্তা করতেন আমার স্বামী। তিনি নিজে অতটা পড়াশোনা করেননি। তাই তাঁর সব সময় চেষ্টা থাকত, যাতে আমাদের তিন ছেলেমেয়ে ভাল করে পড়াশোনা করে। কারণ পর্বতারোহনের গাইড হওয়ার এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে তারা যেন সরে আসে। পড়াশোনা করে, অন্য কাজ করে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারে। কারাকোরামে যাওয়ার আগে ২৯ জুন অল্প সময় একটু কথা হয়েছিল ফোনে। ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করছে কিনা তা জানতে চেয়েছিল। কাজ শেষ হলেই ফিরে আসবে বলেছিল। বারবার ওর এমন বাইরে যাওয়া আর আমাদের একা থাকার অভ্যেসটা মানিয়ে ফেলেছিলাম এই কয়েক বছরে। কিন্ত মনে মনে একটা অজানা ভয় কাজ করত। কিন্তু স্বামীর পেশা। তাই মন না চাইলেও তাঁকে যেতে দিতে হত।
প্র: কী চান সরকারের কাছে?
উ: স্বামীর দুর্ঘটনার পর কেউ সেরকম ভাবে খোঁজ নিল না আমারদের। তিন ছেলেমেয়ের পড়াশোনা আছে। সংসারের মূল আয়ের উৎস ছিলেন আমার স্বামী। আমি কীভাবে এবার সংসার চালাব বুঝতেই পারছি না। পড়াশোনার এত খরচ ছেলেমেয়েদের। কিছুই ভেবে উঠতে পারছি না। এর আগে অন্য এক পর্বতারোহী ছন্দা গায়েনের সঙ্গে গিয়ে আমার ভাই গ্যাঞ্জেন শেরপার ছেলে তেম্বা শেরপা এবং এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় দাওয়া উংচুক হারিয়ে গেল। তখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওঁর স্ত্রীকে একটি সরকারি কাজ দিয়েছিল। আমরা তো স্বাভাবিকভাবেই আশা করব, আমাদের পরিবারে এরকম একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। অন্তত কেউ আমাদের পাশে দাঁড়াক। আমার নিখোঁজ স্বামীকে খোঁজ করার ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের কাছে সাহায্য আশা করেছিলাম। কিন্তু তাও তো হল না।
২০০০ সালে প্রথমবার এভারেস্টে ওঠেন পেম্বা শেরপা। মোট আটবার এই সর্বোচ্চ শিখর ছোঁয়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন তিনি। মাকালু, মানসলু, কাঞ্চনজঙ্ঘা-সহ একাধিক শৃঙ্গ জয়ে, অভিযাত্রীদের সঙ্গী ছিলেন। সম্প্রতি, কারাকোরাম পর্বতমালার সাসের কাংরি (৭,৬৭২ মিটার) শৃঙ্গ জয় করে ফেরার পথে হিমালয়ের কোলে নিখোঁজ হয়ে যান পেম্বা।
প্র: দাদাকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন, সহকর্মী হিসেবে আপনার অনুভূতি কেমন?
উ: তাশি শেরপা (পেম্বার ভাই): দাদা আমাদের সবার চেয়ে আলাদা ছিলেন। আমিও প্রশিক্ষণ নিয়ে দাদার সঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘা গিয়েছিলাম। দাদা খুব ভাল গাইড কেবল ছিলেন না, ধরে ধরে, ভালভাবে পাহাড়ে ওঠার প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের সাবধানতা অবলম্বন করার পরামর্শ দিতেন, শেখাতেন। পর্বতারোহনের সঙ্গে যুক্ত আমাদের পরিবারের সকলেই ‘হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট’ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে পেশাদার শেরপার কাজ শুরু করেছিলাম। কিন্ত কাজে নেমে দাদার সঙ্গে থাকাটা আমাদের বিশেষ কাজে লেগেছিল। হাতে-কলমে কাজের অভিজ্ঞতা লাভ করেছি দাদার কাছ থেকে। দাদার সঙ্গে কাজ করে আমি অনেক আত্মবিশ্বাস পেয়েছি। দু’বার এভারেস্টে চড়ার আমার যে সাফল্য, তার অনেকটাই দাদার সঙ্গে থেকে কাজ শেখার ফল। এ বারও দাদার সঙ্গে কারাকোরাম পর্বতমালায় গিয়েছিলাম। কিন্ত আমার শরীর হঠাৎই খারাপ হয়ে পড়ে। তাই মাঝপথেই ওদের ছেড়েই চলে আসতে হয়েছিল। কিন্ত বড়দা পাসাং এবং আমাদের ভাগ্নে পেম্বা সিরিং শেরপা (ভাগ্নের নামও পেম্বা) দাদার সঙ্গে গিয়েছিল। দুর্ঘটনার পর তারা বাড়ি ফিরছে। কিন্তু...
প্র: দুর্ঘটনার পরে কী হল?
উ: খুব পরিচিত দু’একজন ছাড়া কলকাতা বা হাওড়ার কোনও পর্বতারোহন অ্যাসোসিয়েশনের তরফে কেউ খোঁজ নেয়নি। দার্জিলিং পাহাড়ে এরকম প্রায় ৫০টি শেরপা পরিবার রয়েছে। আমার দাদা খুবই পরিচিত এবং জনপ্রিয় ছিলেন সবার কাছে। কারণ দাদা অন্যান্য গাইডদের থেকে একেবারে আলাদা ছিলেন। পাহাড়ে চড়ার পরিকল্পনা, পুরো দলকে দায়িত্ব নিয়ে ওঠানো এবং নামানোর জন্য দাদার উপর ভরসা করতেন সবাই। কারণ যাঁদের সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের যাতে এতটুকু ক্ষতি না হয়, সেদিকে সব সময় নজর রেখে চলতেন তিনি। অনেকগুলি দলের পর্বতারোহীদের গাইড করে নিয়ে গিয়েছিলেন এভারেস্টে। তাদের নাম হয়, সাহায্য মেলে কিন্ত আমাদের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। কোনও জনপ্রতিনিধি বা কোনও সরকারি প্রতিনিধি আমাদের সঙ্গে ব্যথা ভাগ করে নিতে আসেনি। আমাদের জীবন এরকমই। অন্যের কৃতিত্বের জন্য আমরা কাজ করে যাই কেবলমাত্র।
প্র: এর পর কী আবারও স্বামীকে পর্বতারোহণ চালু রাখতে দেবেন?
উ: দাওয়া কিপা (তাশি শেরপার স্ত্রী): কীভাবে কী করব জানি না। এ বছর আমার স্বামীর আরও কয়েকটি চুক্তি রয়েছে পর্বতারোহণ আয়োজনকারী সংস্থাগুলির সঙ্গে। তার মধ্যে একটি রয়েছে নেপালে। অক্টোবরে তাঁর আবার যাওয়ার কথা। কিন্ত আমার মন সায় দিচ্ছে না। এই দুর্ঘটনার পর কী করব এখনও ঠিক করে উঠতে পারিনি আমরা। আমাদেরও ছেলেমেয়ে রয়েছে। আমার ছেলে লোকপা দেন্দি শেরপা ক্লাস নাইনে পড়ছে। ওর পড়াশোনা, সংসার চালানোও জরুরি। তাই আবার না গেলেও নয়। নেপালের মানসোলু শৃঙ্গ পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম শৃঙ্গ। ঝুঁকি রয়েছে। এই ঘটনার পর, আমার স্বামী এখনও ঠিক করে উঠতে পারছেন না সে কী করবেন।
প্র: বাবা এত জনপ্রিয়, বাড়িতে তোমাদের সঙ্গে কীভাবে সময় দিতেন?
উ: (পেম্বার দুই মেয়ে লাকপা ডোলমা শেরপা, দ্বাদশ শ্রেণি ও ফুরলামু ডোলমা শেরপা, নবম শ্রেণি): বাবা বাড়িতে সেরকম সময় দিতে পারতেন না। সারা বছরে বেশ কয়েকবার অভিযানে যাওয়া, তার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত থাকতেন। ফোনে অল্প কথা হত। তবে আমাদের মনে পড়ে, আমাদের বাৎসরিক লোসার উৎসবের সময় যে বার বাবা বাড়িতে থাকতেন, সেই সময় নতুন জামাকাপড়, খাওয়া দাওয়া, একসঙ্গে বেড়াতে যেতাম আমরা, না হলে সিনেমা দেখতে তো যেতামই। বাড়িতে থাকলে বাবা চিকেনের কিছু আইটেম বানাতেন আমাদের সকলের জন্যে। বাবা কখনও রান্না করতেন, আমরা সাহায্য করতাম। এ বারও যাওয়ার সময় বাবা বলে গিয়েছিলেন, তোমরা ভাল করে করে পড়ো, আমি ফিরে আসব কাজ শেষ হয়ে গেলেই।
প্র: বাবার পেশায় আসতে চাও?
উ: ফুরতেম্বা শেরপা (পেম্বা শেরপার ছেলে, ষষ্ঠ শ্রেণি): বাবা নিজে কোনওদিনও চাননি, আমাদের এই প্রজন্মের কেউ বাবা, কাকা, জেঠুদের মতো এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যোগ দিই। আমার জ্যেঠু মিনমা শেরপার ছেলে তেনজিং শেরপা ট্রেকিংয়ের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। আমার মামাতো ভাই পেম্বা শিরিংও শেরপা। তবে আমি নিজে পড়াশোনার সঙ্গে ছবি আঁকা শিখি। আমার সেটাতেই বেশি উৎসাহ। আমি বাবার একটি ছবি নিজে হাতে তৈরি করব বলে ভেবেছি। আমরা সকলেই বাবার জন্য খুবই গর্ব বোধ করি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy