প্রথম দফার মন্ত্রিত্বের সময়েই বাবুল সম্পর্কে সরকারের অন্দরে নানা অনুযোগ শোনা যেত। তাঁর জীবনযাপন নিয়েও দলের একটা অংশের অনুযোগ ছিল। বলিউডি বিনোদন জগতের প্রতিভূ বাবুল সর্বত্র গিয়ে গান গাইতেন। মোটরসাইকেল দাবড়ে বেড়াতেন রাজধানীতে। যা কখনও সখনও নিরাপত্তারক্ষীদেরও বিপাকে ফেলেছে। বাবুলের ঘনিষ্ঠরা জানেন, একবার মোটরসাইকেল চালিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ঢুকতে গিয়েছিলেন বাবুল। তাঁকে প্রধান ফটকেই আটকে দেন নিরাপত্তারক্ষীরা। সেই জল এতদূর গড়ায় যে, হস্তক্ষেপ করতে হয় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে। তিনি বাবুলকে বুঝিয়ে বলেন যে, একজন মন্ত্রীর পক্ষে এ ভাবে নিরাপত্তার ঝুঁকি নেওয়াটা ঠিক নয়।
বিজেপি-র একটা অংশের আপত্তি ছিল বাবুলের ‘পাবলিক পারফরম্যান্স’ নিয়েও। অনুষ্ঠানের ওজন বিচার না করেই গান গাইতে শুরু করতেন মন্ত্রী। একবার স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে পাছে গান শুরু করেন ভেবে তাঁর সচিব সাবধান করে তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘স্যর, এখানে কিন্তু গান গাইবেন না!’’ বলিউডের বিভিন্ন সুপারহিট গানের রূপকার বাবুল সে যাত্রা আর গানটা করেননি।
তার পরেও দ্বিতীয় দফায় বাবুলকে কেন্দ্রে মন্ত্রী করা হয়েছিল তাঁর লোকসভায় বিপুল জয়ের কারণে। কিন্তু তুলনায় কম গুরুত্বের দফতর দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। কারণ, বিভিন্ন অনুযোগ তখনও রয়েই গিয়েছিল। তা অনেকটা জলবাতাস পায় বিধানসভা ভোটের প্রচারে টালিগঞ্জের রাস্তায় বাবুল মোটরসাইকেল নিয়ে নেমে পড়ায়। বিজেপি-র শীর্ষনেতৃত্ব মনে করেছিলেন, ওই স্টাইলের প্রচারে রাজনীতি কম, বলিউডের ‘মজলিসি’ ছোঁয়া বেশি রয়েছে। অমিত শাহ-সহ দলের শীর্ষনেতারা ওই ধরনের প্রচারকে খুব ভাল চোখে দেখেননি। বাবুল ভোটে হেরে যাওয়ায় দলের অন্দরে তাঁর নিন্দকেরা আরও উৎসাহী হয়ে ওঠেন।
সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনের রিপোর্ট কার্ড বলছে, সফল হননি রাজনীতিক বাবুল। টালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রে হেরে গিয়েছেন। আসনসোলের সাতটি বিধানসভার মধ্যে আসানসোল দক্ষিণ এবং কুলটি ছাড়া কোথাও জয় পায়নি বিজেপি। বাবুলের সমর্থকেরা অবশ্য বলছেন, নিজে বিধানসভা ভোটের প্রচারে ব্যস্ত থাকায় আসানসোলে সময় এবং নজর দিতে পারেননি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। তবে এর বিপক্ষেও যুক্তি দেওয়ার লোক আছে। যে অংশ বলছে, বাবুল নিজে না থাকলেও তাঁর লোকসভা এলাকার সংগঠন তো ছিল!
নীলবাড়ির লড়াইয়ে গোটা রাজ্যেই বিজেপি-র ফল খারাপ। কিন্তু যে সাংসদদের এলাকায় ফল বেশি খারাপ, তাঁদের অন্যতম বাবুল। বাবুলের চেয়েও খারাপ ফল হয়েছে লকেট চট্টোপাধ্যায়ের হুগলি এবং কুনার হেমব্রমের ঝাড়গ্রামে। কিন্তু তাঁরা তো আর মন্ত্রী নন যে, ছেঁটে ফেলে বার্তা দেওয়া হবে। বুধবার সকালেই বাবুলকে তাঁর মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করতে বলা হয়। কিন্তু বাবুল স্বয়ং সেটা মানতে রাজি নন। নিজের ফেসবুকেও ওয়ালে তিনি লিখেছেন, ‘ইস্তফা দিতে বলা হয়েছে’ কথায় তাঁর আপত্তি রয়েছে। তবে মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন বাবুল। জানিয়েছেন, এতে তিনি দুঃখিত।
টানা সাতবছর মন্ত্রী ছিলেন বাবুল। ২০১৪ সালে প্রথম হন কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন দফতরের প্রতিমন্ত্রী। এর পরে ২০১৬ সালে দফতর বদলে হয় ভারী শিল্প এবং রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প। ২০১৯ সালে সাংসদ হওয়ার পরে বাবুল তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ দফতর (পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন) পেয়েছিলেন বলেই বিজেপি-র অনেকে মনে করেন। তবে বিজেপি-র একটি সূত্রের দাবি,নিজের লোকসভা এলাকায় বিধানসভা নির্বাচনে খারাপ ফল ছাড়াও তৃণমূল থেকে জিতেন্দ্র তিওয়ারিকে বিজেপি-তে নেওয়ার বিষয়ে প্রকাশ্যে আপত্তি তোলা-সহ থেকে মোটর সাইকেল নিয়ে ভোটের প্রচারের মতো বিষয়ে বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পছন্দ করেননি। তার কোনও প্রভাব বুধবারের সিদ্ধান্ত পড়েছে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে যা নিয়ে বিতর্ক নেই, বাবুল এখন ‘প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী’।