বর্ধমান মেডিক্যালে দেহ দেখে কান্না পরিজনদের। —নিজস্ব চিত্র।
এক রাতেই বিপর্যয় নেমে এল তিন বাড়িতে। তবে শোক সামলে সংসার চালানোর চেয়েও খণ্ডঘোষের ওঁয়াড়ি গ্রামের ওই পরিবার তিনটির বড় ভাবনা, ছেলেমেয়েদের এখন পড়াবেন কীভাবে?
রবিবার গভীর রাতে তৃণমূলের ব্লক সভাপতি ও প্রাক্তন ব্লক সভাপতির ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে তিন তৃণমূল কর্মী খুনের অভিযোগ ওঠে খণ্ডঘোষে। তাঁদের মধ্যে শেখ সওকত ও মহম্মদ জামালউদ্দিন ওঁয়াড়ি গ্রামেরই বাসিন্দা। আর এক জন, শেখ আইনাল লায়েকের বাড়ি খণ্ডঘোষের উজলপুকুর গ্রামে। সোমবার স্বামীর মৃত্যুর খবর পেয়ে আইনাল লায়েকের হালিমা বিবি বলেন, ‘‘স্বামীর উপর আক্রমণ যে হতেই পারে, সে কথা জানতাম। উনিই বলেছিলেন, কেউ ডাকতে এলে বলবে আমি বাড়িতে নেই। রবিবার রাতেও দু’চার জন ডাকতে এসেছিল। তাঁদের বলেছিলাম বাড়িতে নেই। তারপর রাতে কখন বেরিয়ে গিয়েছে বুঝিনি।’’ এমনিতেই তালপাতার চাটাই বুনে সংসার, ছেলের পড়াশোনার সব খরচই সামলাতেন হালিমা বিবি। গত কয়েক বছর ধরে স্বামী যে সংসার চালানোর জন্য কোনও টাকা দিতেন না, তাও কাঁদতে কাঁদতে জানালেন নিজেই। হালিমা বিবির কথায়, ‘‘এক চিলতে ঘরে থাকি। কোনও রকমে সংসার চালাই। ধারদেনা শুধে ছেলেদের পড়াশোনা কীভাবে চালাব জানি না।’’
আইনুল লায়েকের দুই ছেলের মধ্যে বড় আশাদুল বিবাহিত। কাঠের কাজ করেন তিনি। আর ছোট ইমদাদুল কেতুগ্রামে বিএড পড়েন। আত্মীয়েরা জানান, মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত সব পরীক্ষাতেই ৬০ শতাংশের উপর নম্বর পেয়েছেন ইমদাদুল। ২০১৩ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর পাশ করেন। আগামী শুক্রবার বি এড-এর পরীক্ষা ছিল তাঁর। তাঁর আগেই এই খবরে যেন থম মেরে গিয়েছেন তিনি। কোনও রকমে বললেন, ‘‘পড়ার খরচ চালাতে গিয়ে এক আত্মীয়ের কাছে প্রায় ১ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা ধার হয়ে গিয়েছে। জানি না শোধ দেহ কীভাবে।” ছেলের অবস্থা দেখে তাঁক বুকে জড়িয়ে হালিমা বিবিও বলেন, “আমার স্বামীকে যাঁরা খুন করেছেন, তাঁদের আমি কোনও ক্ষতি চাইছি না। যে চলে যাবার, সে তো চলেই গিয়েছে। অনেক কষ্ট করে ছেলেকে পড়িয়েছি। আল্লার কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন ছেলের দিকে মুখ তুলে তাকান।”
ওঁয়ারি গ্রামের চৌধুরী পাড়ার শেখ সওকতের বাড়ির ছবিটাও অনেকটা একই। তাঁর স্ত্রী এসমতারা বিবির দাবি, ‘‘রাতের খাওয়া শেষ হওয়ার পরেই মোবাইল বেজে ওঠে। স্বামী মোবাইল রেখে একটু আসছি বলে বেরিয়ে যান। আর ফেরেন নি। পরে ভোরবেলায় খবর আসে, সব শেষ।’’ সওকতের দুই মেয়ে। বড় মেয়ে মৌসুমী এ বছর উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছেন। আর ছোট মেয়ে ঝুমা নবম শ্রেণির ছাত্রী। সওকত স্থানীয় একটি চালকলের কর্মী ছিলেন। এসমাতারা বিবি বলেন, “রাজনীতি করে ছেড়ে দিয়ে কাজে মন দিয়েছিল। ভেবেছিলাম চালকল থেকেই বোধহয় ফোন এসেছে। কিন্তু ওটাই যে শেষ ফোন বুঝতে পারিনি।’’ কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘‘রোজার সময়, কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল নেই। মাঝরাতে উঠে দেখি তখনও ফেরেনি। তখনই মনটা কু ডাকছিল।” তাঁদের এখন চিন্তা, সংসার চলবে কীভাবে, মেয়েদুটোর পড়াশোনারই বা কী হবে। আর এক নিহত, মহম্মদ জামালউদ্দিনেরও দুই মেয়ে। বড় মেয়ে বিবাহিত, ছোট মেয়ে আসমিনা খাতুন স্নাতক স্তরের ছাত্রী। তাঁর স্ত্রী জেসমিন বিবি বলেন, “হুমকির মুখেও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে ছাড়ত না। কখন কী হয় ভেবে রাজনীতি করতে বারণ করতাম। সেই রাজনীতির জন্য আমার সব শেষ হয়ে গেল। এখন মেয়েকে কী করে পড়াব, সেটাই চিন্তা।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy