Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

যৌনকর্মীদের সমবায়ে বছরে লেনদেন ৩০ কোটি!

সারাদিনের রোজগার বিছানার তোষকের নীচে জমিয়ে রাখতেন সোনাগাছির যৌনকর্মী মালা দাস। সে কথা বিশ্বাস করে বলেছিলেন এক ‘বাবু’কে। সব টাকা হাতিয়ে এক দিন চম্পট দিল সেই বাবু।

সৌভিক চক্রবর্তী ও মধুরিমা দত্ত
শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ১৭:৪৬
Share: Save:

সারাদিনের রোজগার বিছানার তোষকের নীচে জমিয়ে রাখতেন সোনাগাছির যৌনকর্মী মালা দাস। সে কথা বিশ্বাস করে বলেছিলেন এক ‘বাবু’কে। সব টাকা হাতিয়ে এক দিন চম্পট দিল সেই বাবু।

মেয়ের বিয়ে দেবেন বলে কিস্তিওয়ালার কাছ থেকে দশ হাজার টাকা ধার করেছিলেন যৌনকর্মী খাদেজা বিবি। চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকা সেই ধারের বোঝা বইতে না পেরে অবশেষে বেছে নিয়েছিলেন আত্মহত্যার পথ।

শুধু মালা দেবী বা খাদেজা দেবী নন এ রকমই অবস্থা ছিল অসংখ্য যৌনকর্মীর। তাঁরা কোনও সরকারি ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরে ভবিষ্যত সুরক্ষার জন্য টাকা জমাতে পারতেন না। কারণ তাঁদের না ছিল কোনও পরিচয়পত্র, না ছিল নাগরিক স্বীকৃতি। বাধ্য হয়েই তাঁরা টাকা রাখতেন কখনও তোষকের নীচে কখনও বা বাবুর হেফাজতে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই টাকা মেরে পালিয়ে যেত বাবুরা। তা ছাড়া যৌনকর্মীদের প্রয়োজনে চড়া সুদে টাকা ধার দিত কিস্তিওয়ালা-চটাওয়ালারা। আর এক বার ধার করলে চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকা সুদের কবল থেকে বেরোনোর কোনও উপায় থাকত না। ধারের বোঝা বইতে হত আমৃত্যু।

কিন্তু, এখন সেই অবস্থা পাল্টেছে। কী ভাবে?

যৌনকর্মী শেফালী রায় জানান, কয়েক জন যৌনকর্মী মিলে একটা সমবায় গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। যেখানে তাঁরা তাঁদের ভবিষ্যতের জন্য টাকা জমাতে পারবেন, প্রয়োজনে ধার নিতেও পারবেন। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে পুলিশ থেকে শুরু করে বাড়ির মালিক এবং মহাজনরা আমাদের উপর অত্যাচার করত। যে কোনও ভাবে হোক আমরা এর থেকে মুক্তি পেতে চাইছিলাম। চাইছিলাম স্বাবলম্বী হতে।’’ স্বপ্ন দেখার সেই শুরু। কিন্তু, সেই স্বপ্ন যে এ রকম মহীরূহ হয়ে উঠবে তা তখন বুঝতে পারেননি শেফালীরা।

সময়টা ১৯৯৩-৯৪। সোনাগাছির গুটিকয়েক যৌনকর্মীর পাশে এসে দাঁড়ায় দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি। তৈরি হয় ‘ঊষা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি’। শুরু মাত্র ১৩ জন যৌনকর্মীকে নিয়ে। আজ বছর কুড়ি পর ঊষার সদস্যসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ হাজারেরও বেশি। সারা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার যৌনকর্মীরা ঊষার সদস্য। বছরে লেনদেন প্রায় ৩০ কোটি টাকা।

কী ভাবে চলে এই সমবায়?

ঊষার ফিনান্স ম্যানেজার শান্তনু চট্টোপাধ্যায় জানান, এই সমবায়ে টাকা রাখার জন্য যৌনকর্মীরা যে কোনও সময়ে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন, নিজের ইচ্ছে মতো টাকা জমাতে পারেন, তুলতেও পারেন। প্রয়োজনে সরকার স্বীকৃত সরল সুদে ধারও নিতে পারেন। তিনি আরও জানান, ২০১৪-১৫ আর্থিক বছরে যৌনকর্মীরা ঊষা থেকে ধার নিয়েছেন ৭ কোটি টাকা। কেন টাকা ধার করেছেন যৌনকর্মীরা? সমবায়ের আধিকারিকরা দেখেছেন, ধার নিতে আসা যৌনকর্মীদের ৪২ শতাংশই ধার নিয়েছেন সন্তানদের শিক্ষার জন্য। শান্তনুবাবু বলেন, ‘‘এই সমবায়ের সব কিছুই যৌনকর্মীদের নিয়ে। তাঁরাই এখানকার সংগ্রাহক আবার তাঁদেরই কেউ বোর্ডের সভাপতি, সম্পাদক বা হিসাবরক্ষক।’’

কেমন ছিল শুরুর সেই দিনগুলো?

যৌনকর্মীদের কথায়, সহজ ছিল না লড়াইটা। শুরু থেকেই একের পর এক বাধা এসেছে। কখনও বাড়ির মালিক বাড়ি-ছাড়া করার ভয় দেখিয়েছে আবার কখনও বা কিস্তিওয়ালাদের ভাড়া করা গুন্ডা হুমকি দিয়েছে প্রাণে মারার। অন্য যৌনকর্মীরাও ভেবেছেন, এটাও বুঝি আর এক রকম টাকা মারার ফন্দি। ধীরে ধীরে সকলের বিশ্বাস অর্জন করতে হয়েছে। শান্তনুবাবুর কথায়: ‘‘সবচেয়ে বড় বাধাটা এসেছিল সমবায় মন্ত্রকের তরফে। ১৯৯৫ সালে যৌনকর্মীরা সমবায়টির সরকারি স্বীকৃতির জন্য আবেদন করলে সমবায় মন্ত্রকের আধিকারিকেরা আবেদন নাকচ করে দেন। কারণ ১৯৮৩ সালের সমবায় আইনে বলা আছে ‘উন্নত চরিত্রের’ অধিকারী না হলে সমবায় গঠন করা যায় না।’’

ঊষার অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার শতাব্দী সাহা বলেন, ‘‘এই ঘটনার প্রতিবাদ করেন যৌনকর্মীরা।’’ তিনি জানান, ঊষার বর্তমান মুখ্য উপদেষ্টা চিকিৎসক স্মরজিৎ জানা সেই সময় বলেন, চরিত্রের ধারণা আপেক্ষিক। অবশেষে তৎকালীন সমবায় মন্ত্রী সরল দেবের হস্তক্ষেপে সমবায় আইন থেকেই বাদ হয়ে যায় ‘উন্নত চরিত্র’ কথাটি। শতাব্দী দেবীর কথায়, ‘‘১৯৯৫-এর ২১ জুন স্বীকৃতি পায় ঊষা।’’

প্রথমে পশ্চিমবঙ্গের ৬টি জেলায় এবং পরে ২০০৯-এ সারা পশ্চিমবঙ্গের যৌনকর্মীদের এই সমবায়ের আওতায় আনার অধিকার অর্জন করে ঊষা। সে বছরই লোকসভা নির্বাচনের আগে ঊষার পাশবই দেখে দর্জিপাড়া গণভবনে এক দিনে ৭০০ যৌনকর্মীর নাম ভোটার তালিকায় তোলেন নির্বাচন কমিশন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর সে দিন নাগরিক স্বীকৃতি পেলেন যৌনকর্মীরা।

এ বছর কুড়িতে পা দিল রিতা দেবী, শেফালী দেবী, মৌরজান মোল্লাদের সাধের ঊষা। এই কুড়ি বছরে টাকা জমিয়ে তাঁরা কেউ বোলপুর বা সুন্দরবনে বাড়ি করেছেন, ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন, মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, কেউ বা মা-বাবাকে ঘুরিয়ে এনেছেন পুরী-হরিদ্বার। ধরা গলায় শেফালী দেবী বলেন, ‘‘মেয়ের বিয়ে দেওয়ার সময় আমি কিচ্ছু লুকোইনি। এখন আমি আমার পেশা নিয়ে লজ্জিত নই। ঊষা আমায় মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখিয়েছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sonagachi cooperative kolkata MoatReadStories
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE