Advertisement
২১ মে ২০২৪
অন্য পুজো

আউট হতে ভাল লাগত না ওর, তবু...

তোমার যে তিনটে ছেলে আছে তা তো বিয়ের আগে বলোনি আমায়? স্ত্রী মধুমিতার কথায় প্রথমে হকচকিয়ে গিয়েছিলেন বাপ্পা। হেসে ফেলে পাল্টা শোনান, আছে বইকী! আর শোনো, বুড়ো বয়সে তুমি কী করবে জানি না, কিন্তু এই ছেলেরা কেউ আমায় ফেলবে না।

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৫ ০৪:০৯
Share: Save:

তোমার যে তিনটে ছেলে আছে তা তো বিয়ের আগে বলোনি আমায়?

স্ত্রী মধুমিতার কথায় প্রথমে হকচকিয়ে গিয়েছিলেন বাপ্পা। হেসে ফেলে পাল্টা শোনান, আছে বইকী! আর শোনো, বুড়ো বয়সে তুমি কী করবে জানি না, কিন্তু এই ছেলেরা কেউ আমায় ফেলবে না।

এমনিতে কুড়ি-একুশ বছরের তিন ছেলের জন্ম দেওয়াটা কিঞ্চিৎ বাড়াবাড়ি হতো আটত্রিশের অরিজিৎ মজুমদার ওরফে ময়দানের বাপ্পাদার পক্ষে। তবে ছাত্র ও পুত্রে তো বিশেষ ফারাক নেই!

অভিজিৎ মণ্ডল, ওয়াসিম আহমেদ এবং অঙ্কিত কেশরীর মধ্যে অঙ্কিতটাই সব থেকে আদুরে। তিন জনই সব কথা না-বলে থাকতে পারে না বাপ্পাদাকে। কিন্তু যখন যেটা মনে ঘুরপাক খাবে, অঙ্কিতের সেটা তক্ষুনি না-জানালে তর সয় না। কোনও কারণে ফোন না-ধরলে প্রায় ঠোঁট ফোলানো অভিমান।

প্রশ্নের অন্ত নেই! ‘ভাগ মিলখা ভাগ’-এ প্রেমঘটিত টানাপড়েনে মিলখার পারফরম্যান্সে ঘাটতি দেখে ঘোর দুশ্চিন্তা। এ সব আবার কী? বাপ্পাদা হেসে উড়িয়ে দেন, সব কিছুই জীবনের অঙ্গ। ঘাড় নেড়ে গম্ভীর মুখে ওইটুকু ছেলের প্রাজ্ঞ উপলব্ধি, ‘‘না না, স্বপ্নটা অন্য রকম হলে লাইফটাই বা কী করে সবার মতো হবে? এখন থাক ও সব।’’

বাইশ গজে তুখোড় ওপেনারের ডিফেন্সের মতো জীবন জুড়েও নিশ্ছিদ্র সতর্কতা ছিল। চোট লাগবে বলে ফুটবলও খেলতে চাইত না। তবু মোক্ষম চোটটা এড়াতে পারল কই!

অঙ্কিতকে চাঙ্গা করতে বাপ্পাদাকে কখনও কোনির ক্ষিদ্দার মতো মুঠি পাকিয়ে ‘ফাইট ফাইট’ বলতে হয়নি। উল্টে ও-ই যেন চমকে দিত! সেই প্রথম দিন থেকেই। দ্বিতীয় ডিভিশনের একটা ম্যাচে স্টার স্পোর্টিংয়ের হয়ে আট নম্বরে নেমেছিল ছেলেটা। তখনও লেগস্পিনার বলেই ওকে চেনে ময়দান। এক জন টেল এন্ডার সোজা ব্যাটে খেলছে প্রতিটা বল। অফ স্টাম্পের বাইরে ফালতু খোঁচার ছটফটানি নেই।

বাপ্পার মনে হয়, এ তো আদর্শ ওপেনিং ব্যাট। বেশ খেলিস তো! শুনে বছর চোদ্দোর ছেলেটা অবাক করে বলেছিল, ‘‘আমার আউট হতে ভাল লাগে না!’’

চিন্নাস্বামীতে ন্যাশনাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমির ক্যাম্প, ইডেনের সবুজ গালচে, ঘরোয়া ক্রিকেটের হাইকোর্ট, কাস্টমস কি যাদবপুরের মাঠে মাটি কামড়ে আউট হতে না-চাওয়া সেই জেদ এখন সব প্রতিযোগিতার বাইরে।

বিবেকানন্দ পার্কে বুলান ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্পের মাঠটাই ছিল অঙ্কিতের ঘরবাড়ি। পারলে সপ্তাহে ছ’দিন ওখানে প্র্যাকটিস করে! ইন্ডিয়া তো সব ক্রিকেটারই খেলতে চায়। কিন্তু ও, নিজেই নিজের পথ বেঁধে দিত। একটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনা। ধাপে ধাপে কী ভাবে এগোতে হবে, একটা ইনিংসে কখন কী করা উচিত— ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে সব লিখে রাখত ডায়েরিতে।

বিবেকানন্দ পার্কের ঘাসে-ঘাসে সেই স্বপ্ন কাটা ঘুড়ির মতো পড়ে থাকে। পুজোয় এই মাঠ থেকেই কলকাতা শাসন করতে বেরোত ওরা। ক্রিকেটটা মনপ্রাণ দিয়ে খেলে, এমন জনা পনেরো, মধ্যমণি বাপ্পাদা মিলে প্রথমে সমাজসেবী-বালিগঞ্জ কালচারাল দিয়ে অভিযানের শুরু। দক্ষিণ কলকাতার বড়-বড় পুজো ঘুরেটুরে কাছেপিঠে কোথাও হইহই করে চাইনিজ ডিনার। ‘বাপ্পাদা, আজ কিন্তু আমরা তোমায় খাওয়াব!’ বছরভর যখন-তখন কোচের বাড়িতেই তো ছেলেরা পড়ে থাকে। ইচ্ছেমতো খায়, ঘুমোয়। পুজোর দিনটায় ছেলেরাই ওঁর অভিভাবক।

এ বার ও-সব ঘোরাঘুরি-খাওয়াদাওয়া কিচ্ছু হবে না। পুজোর কলকাতা কাঁটার মতো বিঁধছে অঙ্কিতের বাপ্পাদাকে।

বাঁশদ্রোণীর নতুনবাজারের তস্য গলিতেও পুজোর বাতাস ঢুকতে পারে না। দোতলার সিমেন্টের গাঁথনিটুকু শুধু শেষ হয়েছে। শেষ না-হওয়া পুজো প্যান্ডেলের মতো সব কিছু ওই ভাবেই পড়ে।

গেল-পুজোয় ওই সিমেন্টের গাঁথনির খাঁচাটাতেই রাত পর্যন্ত কেক কেটে ওর মামাতো ভাইয়ের ‘বার্থ ডে’য় খুব মজা করেছিল। পয়লা বৈশাখ পাড়ার চেনা মিস্ত্রিকে ডেকে দোতলায় তাড়াতাড়ি একটা ঘর করতে বলল বাড়ির ছোট ছেলে। তার ক’দিন বাদেই তো...।

একতলার খুপরি বাইরের ঘরে ওইটুকু খাটে পা দু’টো বেরিয়ে থাকত ছ’ফুট ছুঁইছুঁই শরীরটার। নির্মলা কেশরী এখন সে-খাটে শুয়েই ঘুমের ঘোরে হাতড়ে হাতড়ে ছেলের চুলে বিলি কাটেন। অন্য ঘরটায় ওর ভাবি আর দশ বছরের বড় ভাই দীপক। এ ঘরটায় মেঝেয় শুয়ে অঙ্কিতের বাবা রাজকুমার। খাটে মায়ের পাশে শুয়ে ঘুমোত ছেলেটা।

একটুর জন্য আন্ডার নাইন্টিন ইন্ডিয়া টিম থেকে যখন বাদ পড়ল, কিংবা কোনও দিন লাঞ্চের আগে আউট হলে মাঝরাতে খাটে উঠে বসে থাকত। মাকে বলত, একটা গান গাও মা! আমার সব টেনশন তুমি দূর করে দাও, সেই ছোটবেলার মতো।

ছোটবেলার অঙ্কিতকেই এখন স্বপ্নে দেখেন নির্মলা। প্রায়ই। বাবার ছুড়ে দেওয়া বলটা প্লাস্টিকের ব্যাটের মাঝখানে ছুঁয়ে বাহাদুরিতে নামিয়ে ফেলছে ছোট্ট ছেলে।

গাওস্কর-বিশ্বনাথের ভক্ত রাজকুমার কেশরী তখনই ছেলেকে বোঝাতেন, ‘‘ডিফেন্স কর বেটা!’’ বড় ছেলে দীপক সে-দিন দেখাল, তাঁদের ‘ছোটু’ নিজের ডায়েরিতে লিখে রেখেছিল— ডিফেন্সই বড় ইনিংসের ভিত গড়ে দেয়। ‘‘ডিফেন্স ঠিক রেখেই ডালহৌসির সঙ্গে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে ২০০ করেছিল কিন্তু! আমি মাঠে ছিলাম।’’— পুত্রগর্বে চোখমুখ আলোয় ভরে ওঠে রাজকুমারের।

মায়ের স্বপ্নে শুধু একদিনই ক্রিকেটের সাদা ড্রেস পরে এসেছিল ছেলে। ঘরময় ঘুরে-ঘুরে দেখছিল ওর কিট, স্পনসরের থেকে পাওয়া ব্যাটগুলো, অনূর্ধ্ব উনিশ বেঙ্গল ক্যাপ্টেনের জার্সি, সিএবি-র বর্ষসেরা প্লেয়ারের ট্রফি...।

বাবা-দাদা নতুন শো-কেস করিয়েছে। তাতে সব রাখা হচ্ছে সাজিয়ে। কেন? গলার কাছে আটকে থাকা বুক-ফাটা চিত্কারে ঘরটার দেওয়াল ফুঁড়ে দিতে ইচ্ছে করে নির্মলার। ‘‘জানেন, এই সে-দিন অবধি ওর একটাই সাদা ড্রেস ছিল। পরপর দু’দিন ম্যাচ থাকলে, রাতে সে কী অবস্থা। ঝটপট কেচে পাখার হাওয়ায় শুকোতে প্রাণটা বেরিয়ে যেত।’’ ইস্টবেঙ্গলে ঢোকার পরে এক দিন মাকে বলল, ‘‘তোমার খুব কষ্ট হয়! দাঁড়াও একটা ওয়াশিং মেশিন কিনে দেব।’’ ঘরটায় এসি লাগানোর কথাও বলত। এ বছরটায় কত কী যে করার ছিল!

ভবানীপুরে চা-সিগারেটের শরিকি দোকানে আর কতটুকু হতো! ছোট ছেলের বাইশ গজ-অভিযান ঘিরেই দানা বাঁধছিল একটা স্বপ্ন। দাদা দীপক বলেন, ‘‘আমাদের ফ্যামিলি তবু যত দূর এগোতে পেরেছে, সব ওর জন্য!’’ রাজ্য সরকারের খনি উন্নয়ন নিগমের চাকরিটা অনেক দূরে চলে যাওয়া ভাই-ই দাদাকে ‘গিফ্‌ট’ করে গিয়েছে। ময়দানে বাপ্পাদাকেও এখন এক ডাকে সকলে অঙ্কিতের কোচ বলে চেনে। অস্ফুট গলায় বাপ্পা বলে ওঠেন, ‘‘আমি সত্যিই ভাবতাম, ও এক দিন ইন্ডিয়া খেলবে। ওর জন্যই আমাকে চিনবে সবাই! সেটা এ ভাবে সত্যি হবে কে ভেবেছিল?’’

কে ভেবেছিল, বেমক্কা বাউন্সারে জীবনের ইনিংস থেকে ছিটকে যাওয়া অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যান ফিলিপ হিউজের সঙ্গে অঙ্কিতের নামটাও এখন এক নিঃশ্বাসে উচ্চারণ করবে ক্রিকেটবিশ্ব! সব-হারানো পরিবারের পাশে অবশ্য দাঁড়িয়েছে সিএবি। দাঁড়িয়েছে ইস্টবেঙ্গল, কেকেআর। তবে বিসিসিআই-এর সাহায্য আসতে এখনও অনেক নিয়মের জটিলতা বাকি।

অথচ ভবানীপুরের সঙ্গে সেই ম্যাচটায় অঙ্কিতের তো নামারই কথা ছিল না। বদলি ফিল্ডার হিসেবে নেমেছিল শেষ ওভারে। আর হঠাৎ আকাশে ওঠা বলটায় উইকেটের গন্ধ পেয়ে একস্ট্রা কভার থেকে প্রাণপণে ছুটে শরীর ছুড়ে দিয়েছিল সার্কেলের দিকে। উল্টো দিক থেকে ছুটে আসছিল বোলার সৌরভ মণ্ডলের চেহারাটাও। দু’জনেরই চোখ উড়ন্ত বলের দিকে, কেউ কাউকে দেখেনি। সৌরভের শিনবোন ঘাড়ে এসে লাগার পরে মাঠে মাথাটা ঠুকে গিয়েছিল অঙ্কিতের।

‘‘আমাকে কেউ কোনও দোষ দেননি। তবু এ দুর্ঘটনার ভার আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।’’— সিএবি-র প্র্যাকটিসে ঢোঁক গিলে বলেন সৌরভ। আর বাপ্পা বলে চলেন, ‘‘ভাগ্য ছাড়া সত্যিই কাউকে দোষ দেওয়ার নেই। তবু অঙ্কিত বা সৌরভ, দু’জনেই ভুলে গিয়েছিল, ‘নো-ম্যানস ল্যান্ড’ হলেও ক্যাচের জন্য ঝাঁপালে একটা কল দিতে হয়।’’

এত সাবধানী ছেলেরও এমন ভুল হয় তা হলে! ‘‘এই জন্যই জীবনটা অদ্ভূত মনে হয়’’— বলেন কোচ। যেমন, চোট লাগার এক দিন পরেও হাসপাতালে দিব্যি কথা বলা ছেলেটা হঠাৎ কী ভাবে নিস্তেজ হয়ে পড়ল, মাথায় ঢোকে না মায়ের। কেনই বা হঠাত্ ওকে আমরি থেকে নাইটিঙ্গেল হাসপাতালে পাঠাল ক্লাব? রাতে ডাক্তারবাবু ‘সব ঠিক আছে’ বলার পরেও সাত-সকালে কেন শেষ হয়ে গেল সব? ময়দানের ক্রিকেটাররা প্রশ্ন করেন, একটা অঙ্কিত বলি হওয়ার পরেও ঘরোয়া খেলায় ক’টা মাঠে ডাক্তার-অ্যাম্বুল্যান্স রাখে সিএবি?

এ সব যুক্তি-তর্ক বুঝবে না তিন বছরের আদিত্য। প্রাণের ভাইপো শুধু প্যান্ডেলে যাবে বলে থেকে থেকে খোঁজে তার ‘অঙ্কিতচাচু’কে। পুজোর গন্ধে ছোট ছেলের ডায়েরি পড়া হয় বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে— ‘তোমার জন্য প্রতিটা ম্যাচই জরুরি অঙ্কিত। জাস্ট স্টে দেয়ার... বি দেয়ার টুডে!’

শব্দগুলো ঠোক্কর খায় শোকাচ্ছন্ন ঘরের দেওয়ালে। ক্রিকেট না জীবন, কী লিখেছে গুলিয়ে যায় তখন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

abpnewsletters
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE